বুলন্দশহরের দাঙ্গা: বোতল থেকে সাম্প্রদায়িকতার দৈত্য বেরিয়ে পড়েছে
আপনার চিন্তা-ভাবনা বা কাজকর্মে চরমপন্থা প্রশ্রয় পেলে তা আপনারও ক্ষতি করতে পারে
- Total Shares
এ দেশে নির্বাচনী যুদ্ধে স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো উঠে আসে। এই ইস্যুগুলো যত বেশি প্রাসঙ্গিক ও স্পর্শকাতর হয় তা যেন তত তাড়াতাড়ি নির্বাচনী যুদ্ধ জয়ের তুরুপের তাস হয়ে ওঠে। বাঘের পিঠে সওয়ার হতে সাহসের প্রয়োজন হয়, অসম সাহসের। কিন্তু সবসময় এই মানসিকতার প্রভাব যে ভালোই হয় এমনটা কিন্তু নয়। বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রেই এই মানসিকতা নিজের ক্ষতি ডেকে আনে। এমনকি, মোহভঙ্গের কারণও হয়ে ওঠে। উত্তরপ্রদেশের শাসকরা এখন যা রাজনৈতিক মনোভাব নিয়েছেন তাতে উত্তরপ্রদেশেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সমূহ আশঙ্কা দানা বাঁধছে।
জঙ্গল লাগোয়া বুলন্দশহরে গোমাংসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে - এমনই একটি ছোট্ট গুজবে যে ভাবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হল তা আর যায় হোক, স্বাভাবিক নয়। শাসন ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর তা এই ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। একটি খবর ছড়াল। অথচ সেই খবরটি গুজব না সত্যি তা যাচাই করে দেখার উদ্যোগ কেউই দেখাল না। কেউই প্রশাসনের আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া অবধি অপেক্ষা করল না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সশস্ত্র জনতা সন্ত্রাস ছড়াল। আর এই সন্ত্রাসের জেরে একজন কর্তব্যরত পুলিশকর্মী ও একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হল। আশা করা যায়, তদন্তে এই ঘটনার আরও পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ উঠে আসবে।
জনতার ক্ষোভে প্রাণ গেল কর্তব্যরত এক পুলিশ আধিকারিকের [ছবি: পিটিআই]
কিন্তু আচমকাই জনতা এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল কেন? সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক পথগুলো কেমন যেন বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। প্রায়শই একটি 'আমরা বনাম তোমরা' মার্কা লড়াইয়ের সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। যার প্রভাবে লোকেরা দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। শাসকরা বুলন্দশহরের ঘটনাটি নিয়ে যে মনোভাব দেখিয়েছে তাতে এমন ঘটনা না ঘটার কোনও কারণ অবশ্য নেই।
ক্ষিপ্ত জনতা বুঝিয়ে দিয়েছে যে দক্ষিণ তথা হিন্দুপন্থী যোগী আদিত্যনাথের সরকার বা প্রশাসনের উপর তাদের কোনও আস্থাই নেই। গোমাংসকে কেন্দ্র করে একটি গুজব যে ভাবে জনতাকে পুলিশ প্রশাসন, আইন ও সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণকে খেপিয়ে তুলল। এক, হয় জনতা প্রশাসনের উপর বিশ্বাস না রাখতে ক্ষিপ্ত হয়েছিল, নয়তো এই ঘটনাটির পিছনে অন্য কোনও গভীর কারণ রয়েছে। যে কারণই থাকুক না কেন, ঘটনাটি সমাজের পক্ষে একেবারেই মঙ্গল জনক নয়।
আপনি যদি আপনার চিন্তা-ভাবনা বা কাজকর্মে চরমপন্থাকে প্রশ্রয় দেন তা হলে তা একদিন বুমেরাং হয়ে আপনারও ক্ষতি করতে পারে। ধর্মীয় হানাহানি সৃষ্টি করে কিছুদিনের জন্য হয়তো লাভবান হওয়া যায়। কিন্তু এর মূল্যও দিতে হয়। তারই প্রমাণ পাওয়া গেল বুলন্দশহরের ঘটনাটি থেকে। আমাদের মতো সর্ব ধর্ম সমাজে মানুষের মধ্যে এই ধরণের ভেদাভেদের প্রচেষ্টা কি মেনে নেওয়া চলে? আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। সাধারণ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই কিন্তু এই ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলবে।
বুলন্দশহরের ঘটনা আর যায় হোক না কেন, স্বাভাবিক নয় [ছবি: পিটিআই]
কট্টরপন্থীরা সর্বদাই দেশের গণতন্ত্রকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করবে। তার লক্ষণও আমাদের চোখের সামনে রয়েছে। অসহিষ্ণুতা দু'পক্ষের মধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও, এই প্রবণতা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও চেষ্টাই করা হচ্ছে না। ঘৃণা, অবিশ্বাস ও অসহিষ্ণুতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এতটাই, বৃদ্ধি পাচ্ছে যে নেতানেত্রীদেরও কেউ আর পরোয়া করছেন না।
কেউ যদি সত্যি সত্যিই গোরুর শব কোথাও ফেলে গিয়ে থাকে তাহলে যোগী সরকারের উচিত সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু জনতা সে কথা মানেনি। তারা তেতেই ছিল আর আগুনে ঘি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আসলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার জন্য একটি ছুতো প্রয়োজন ছিল। আর সোশ্যাল মিডিয়াতে ফুটে ওঠা একটি গুজব মানুষকে খেপিয়ে তুলল। জনতা মারমুখী হয়ে পড়ল।
আশা করি বুঝতে পারছেন, বোতলের ভিতর থেকে কোন ধরণের দৈত্যের আবির্ভাব ঘটছে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে