রথ যাত্রা আট বা নয়ের দশকে বিজেপিকে যে লাভ দিয়েছিল, তা এবারের নির্বাচনে দেবে না
শুধুমাত্র বঙ্গ রাজনিতিতে রাজনৈতিক প্রবাহ জারি রাখতেই বিজেপি এই কৌশল নিচ্ছে
- Total Shares
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রস্তাবিত রথযাত্রায় যথেষ্ট রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হয়েছে। রাজনীতির ঘেরাটোপ পেরিয়ে বিষয়টি এখন আদালতের চার দেওয়ালে বন্দি। কলকাতা হাইকোর্টের রায় বিজেপির পক্ষে না যাওয়ায় তারা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবছে।
রথযাত্রা কথাটা শুনলেই কিছু দুঃসহ স্মৃতি মনে ভিড় করে আসে। যদিও, রজনৈতিক লাভের দিক থেকে বিজেপির কাছে রথযাত্রা সুখকর স্মৃতি। আটের দশকে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির গড়ার লক্ষে আন্দোলনে নামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। ১৯৮৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে খারাপ ফল হওয়ায় আসন বাড়াতে বিজেপি কড়া হিন্দুত্বের পথে হাঁটার কৌশল নেয়।
সঙ্ঘ পরিবারের ওই আন্দোলনের ফল ১৯৮৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পায়। সেই নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় ৮৬টি আসন পায়। নির্বাচনে কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় জাতীয় মোর্চার সরকার তৈরি হয়। ওই সংখ্যার জোরে বিজেপির সমর্থন মোর্চা সরকারের কাছে গুরত্বপূর্ন হয়ে ওঠে।
সেই রথযাত্রার সুফল বিজেপি পায়ে ১৯৯১ নির্বাচনে, বিজেপির প্রাপ্য ভোটের হয় দ্বিগুন হয় [সৌজন্যে: টুইটার]
১৯৯০ সালের অগাস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং মন্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে নিম্নবর্গের মানুষদের জন্য সরকারি চাকরিতে ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করেন। এর ফলে বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক যারা সেই উচ্চবর্ণের স্বার্থে আঘাত লাগে। বিজেপি এই অবস্থায় নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক বাড়াতে রাম মন্দির আন্দোলনকে ব্যবসার করার কৌশল নেয়।
বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে এই সুযোগে হিন্দু সমাজে বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে এক জায়গায় এনে ভোটে ফায়দা তোলা যাবে। এই লক্ষে ১৯৯০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রথযাত্রার কথা ঘোষণা করেন তৎকালীন বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানি। ২৫ সেপ্টেম্বর সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেন আদবানি। উত্তর ভারতে মন্ডল কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল তাকে সংহত করাই ছিল বিজেপির কৌশল।
দশ হাজার কিলোমিটার প্রস্তাবিত রথযাত্রার শেষ বিন্দু ছিল অযোধ্যা শহর। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও বিহার হয়ে অযোধ্যায় পৌঁছানোর আগে বিহারে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব আদবানিকে গ্রেপ্তার করেন।
রথযাত্রা যত এগিয়ে ছিল ততই একশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে উন্মাদনাও বেড়ে ছিল।
বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের সদস্যরা রথযাত্রার পথে বিভিন্ন জায়গায় হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে, জয়পুর, যোধপুর, আহমেদাবাদ, বরোদা, হায়দরাবাদ ও আরও বহু জায়গায় দাঙ্গা ছড়ায়। দেশের প্রায় ১৬৬টি জায়গায় দাঙ্গা বাধে। সেই দাঙ্গায় প্রায় ৫৬৪জনের মৃত্যু হয়। যেখান দিয়ে রথ যায়নি এমন অনেক জায়গাতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।
এই রথযাত্রার সুফল বিজেপি পায়ে ১৯৯১ লোকসভা নির্বাচনে। বিজেপির প্রাপ্য ভোটের হয় দ্বিগুন হয়। লোকসভায় তারাই হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। উত্তরপ্রদেশেও বিধানসভা নির্বাচনে জিতে সরকার গড়ে বিজেপি।
তবে আমার মনে হয় রথ যাত্রা আট বা নয়ের দশকে বিজেপিকে যে লাভ দিয়েছিল তা এবারের নির্বাচনে দেবে না। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে সাম্প্রতিক ভোটে সেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। যোগী আদিত্যনাথকে সামনে রেখে ভোটে কড়া হিন্দুত্বের প্রচার কাজে আসেনি।
তাহলে, বিজেপি কেন পশ্চিমবঙ্গে রথযাত্রা করার কৌশল নিতে চাইছে?
যোগী আদিত্যনাথের হিন্দুত্ব রাজনীতি বিধানসভা নির্বাচনে কাজে আসেনি [ছবি: পিটিআই]
আমার মতে, বঙ্গ রাজনিতিতে রাজনৈতিক প্রবাহ জারি রাখতেই বিজেপি এই কৌশল নিচ্ছে। বঙ্গে নির্বাচনী ফলের যেটুকু বিজেপির পক্ষে রয়েছে তার পিছনে বামদলগুলোর একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। রাজ্যের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলিতে ও পঞ্চায়েত ভোটে বাম ভোটারদের বড় অংশ তৃণমূলকে জব্দ করতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে।তাদের ভোটে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট বাড়লেও তার সংগঠন তেমন বাড়েনি।
বিজেপি নেতৃত্ব জানে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত এই রাজ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের এনে রাজনৈতিক প্রবাহ জারি রাখতে মজবুত সংগঠন দরকার। যে সংগঠন ভোটের ময়দানে, জনসভায় ভোট জড়ো করবে।
বামদলগুলোর ভোটাররা তৃণমূলকে জব্দ করতে তাদের ভোট দিলেও বিজেপি ঝাণ্ডা হাতে সরাসরি পথে নামবে না। খুব ছোট একটা অংশ হয়ত নামতে পারে। এই অবস্থায় প্রচার ধরে রাখতেই রথযাত্রার কথা বলছে বিজেপি।
তারা জানে রথযাত্রায় তৃণমূল সরকার বাধা দেবে। সেই সুযোগে আদালতে মামলা করে এবং গরম গরম মন্তব্য করে সংবাদমাধ্যমে প্রচার পাওয়া যাবে। পাশাপাশি নিজের যেটুকু সংগঠন রয়েছে তাকে চাঙ্গা রাখা যাবে। এই হট্টগোলের মাঝে কেন্দ্রীয় নেতাদের এনে জনসভা করলে সংবাদমাধ্যমের প্রচারে থাকা যাবে। আর, এই ডামাডোলের মধ্যে সেই জনসভায় ভিড় উপচে পড়ল কিনা তা নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামাবে না।
পাশাপাশি রথযাত্রার নামে যদি ভোটের বাক্সে কিছুটা মেরুকরণ হয় তাতে লাভ বৈ ক্ষতি নেই।
এই লাভের জন্যই বিজেপি রথযাত্রার কৌশল নিয়েছে বলেই আমার মনে হয়।