জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক অনুযায়ী বিজেপির প্রচার কোন পথে
ইতিহাস ও পরিসংখ্যান কী ভাবে কাজে লাগাবে বিজেপি
- Total Shares
ইতিহাস ও পরিসংখ্যানের কাটাছেঁড়া। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের অভিমুখ তেমনই যে হতে চলেছে, এ কথা ধরেই নেওয়া যায়। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান নিয়ে কেমন ভাবে খেলা করছে বিজেপি? তারা দেখাচ্ছে, ইউপিএ ১ আমলে কী হারে দাম বেড়েছিল জ্বালানির, আর এনডিএ আমলে তার চেয়ে কত কম হারে বেড়েছে সেই দাম। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি দিয়ে তারা লোকসভার সময় ধরে সেই হিসাব তুলে ধরছে। তবে দেশের লোককে সে কথা বোঝানো মুশকিল হবে।
Truth of hike in diesel prices! pic.twitter.com/gF7CWHeiti
— BJP (@BJP4India) September 10, 2018
डीजल के दामों में बढ़ोतरी का सच! pic.twitter.com/zwdK27OLq5
— BJP (@BJP4India) September 10, 2018
বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ এখন বিজেপিই। দলের কর্মসমিতির বৈঠকে দাবি করা হয়েছে, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের পর থেকে যে ১৫টি রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে ৬টি বাদ দিয়ে প্রতিটিতেই তারা জয়ী হয়েছে। দেশের ২০টি রাজ্যেই তাদের সরকার, কংগ্রেস মাত্র তিনটিতে।
সমস্যা এইখানেই। কারণ এই রাজ্যগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া কাজ করবে। এই অবস্থায় নতুন নতুন ভাবে প্রচারের পরিকল্পনা করেছে বিজেপি।
অজেয় ভারত, অটল বিজেপি
অনেক সময় স্লোগার যে কোথা থেকে ওঠে বোঝা য়ায় না। যেমন ২০১৪ সালে বারাণসী থেকে স্লোগান উঠল “হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী”। এই স্লোগান নিয়ে বিরোধীরা নিন্দা করেছে, তাতে লাভ কিছু হয়নি। নরেন্দ্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এসে গোহারান হেরেছিলেন রাজনীতিতে চমক দেওয়া অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
১০ বছরের কংগ্রেস শাসনে যখন একের পর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, প্রধানমন্ত্রীকে পুতুল করে পিছন থেকে পরিচালনা করার অভিযোগ উঠছিল, একের পর এক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠছিল, তখন বিজেপিই ছিল একমাত্র জায়গা। সর্বভারতীয় দল বলতে প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস ছাড়া বিজেপিই ছিল।
নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ (পিটিআই)
এ বার পরিস্থিতি ভিন্ন। আচ্ছে দিন কী, কাকে বলে, কোথায় সেই দিন এসেছে, ডালের দাম, জ্বালানির দাম নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে বিজেপি। ভোটমুখী রাজনীতির সামনে সংস্কারের ফিরিস্তি খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। তাই এখন নতুন স্লোগান স্থির করেছে বিজেপি, সেই স্লোগানে মোদী নেই, রয়েছেন বাজপেয়ী। প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর উপরে ভর করে রাজনৈতিক বৈতরণী পার করার চেষ্টা করছে বিজেপি।
না নেতা, না নীতি
বিরোধী জোট নিয়ে বিজেপি চিন্তিত, এমন কখনও মনে হয়নি, তবে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে স্পষ্ট, তারা একই তিরে তিন পাখি মারতে চাইছে, বিরোধী জোট, কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধী। বিজেপির স্লোগান থেকেই তা স্পষ্ট।
বিরোধী জোট ক্ষমতায় এলে কে প্রধানমন্ত্রী হবে তা এখনও স্থির হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। কর্নাটক ভোটের প্রচারে গিয়ে রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হতে তাঁর আপত্তি নেই। তবে পরে সেই অবস্থান থেকে তিনি সরে এসে মমতা ও মায়াবতীর নাম করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন এটা ভেবেই ফেডেরাল ফ্রন্টে প্রথন থেকেই কংগ্রেসকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দলের দ্বিতীয় স্তরের নেতারা হাওয়ায় তাঁদের দলের প্রধানের নাম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন। এখন বিরোধীশিবিরে সর্বজনগ্রাহ্য কোনও নেতা নেই।
নেতাও নেই, নীতিই নেই -- বিরোধী ঐক্যকে এই ভাষায় বিঁধছে বিজেপি (ইন্ডিয়া টুডে)
বিজেপি হঠাও কোনও নীতি হতে পারে না, ভোটের ইশতাহারে নির্দিষ্ট ভাবে পরিকল্পনার কথা জানাতে হবে। অন্তত অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি দরকার। কিন্তু এখনও সেই কর্মসূচি স্থির করার কথা ভেবেই উঠতে পারেনি বিরোধী দলগুলি।
কর্নাটকে কুমারস্বামীর শপথ অনুষ্ঠান ও পরে করুণানিধির শোকসভা দেখিয়ে দিয়েছে, বিরোধী শিবির এখনও ঐক্যবদ্ধ নয়। তাই এই জোটের বিরুদ্ধে বিজেপির যুৎসই সবাব হল, না নেতা, না নীতি। এই বন্ধনীতে রাহুল গান্ধীও রয়েছেন। তিনিও এর জবাবে নিজেকে নেতা হিসাবে তুলে ধরতে পারবেন না।
মহাজোটকে ইতিমধ্যেই স্বার্থের জোট বলে প্রচার শুরু করে দিয়েছে বিজেপি।
ভোট মেরুকরণে এনআরসি
রামমন্দির ও কড়া হিন্দুত্ব এখনই সামনে আনছে না বিজেপি। হতে পারে ভোটের আগে এটাই হবে তাদের শেষ মুহূর্তের প্রচারের অস্ত্র। তবে স্থান-কাল বুঝে তাদের মেরুকরণের পথে হাঁটতেই হবে অন্তত পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে আসন বাড়ানোর জন্য। আদিবাসী-প্রধান অঞ্চলেও তারা ভোট মেরুকরণের পথে হাঁটতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ বা এনআরসি-কেও হাতিয়ার করতে পারে।
উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজপার্টির জোট হয় কিনা, হলে কী ভাবে হবে, সেখানে কংগ্রেসের কী ভূমিকা থাকবে, সে সব দেখেই এই রাজ্যে নীতি স্থির করতে হবে বিজেপিকে। দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য এবং লোকসভা আসনের নিরিখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যের জন্য আলাদা ভাবে বাবনা-চিন্তা করতে হবে বিজেপিকে।
উপনির্বাচনের সঙ্গে সাধারণ নির্বাচনের বিস্তর ফারাক থাকলেও, রাজ্যের উপনির্বাচনগুলির ফল চিন্তায় রাখবে বিজেপিকে।
৪৮ বছর বনাম ৪৮ মাস
তবে সংস্কারই বিজেপির প্রধান অস্ত্র, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। এ ব্যাপারে তারা ইতিহাস ও পরিসংখ্যান তুলে ধরবে। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলতে শুরু করেছেন কংগ্রেস শাসনের ৪৮ বছরের সঙ্গে তাঁর ৪৮ মাসের তুলনা করা হচ্ছে। একই মনমোহন জমানা বনাম মোদী জমানার তুলনাও তারা করতে শুরু করেছে।
What the economist PM Manmohan Singh said & did on petroleum prices? He said that money does not grow on trees & left unpaid bills of oil bonds worth Rs. 1.3 lakh crore. Modi govt paid off the pending bills with interest because 'we should not burden our children'. #NationFirst pic.twitter.com/Z8zTV1kG1i
— BJP (@BJP4India) September 10, 2018
তারা বিজেপি আমলের উন্নয়ন ও সংস্কারের প্রসঙ্গ তুলে আনছে। প্রসঙ্গত বাজপেয়ীর কথাও আসছে, এমনকি তারা বাজপেয়ীকেও ভোটের আগে তুলে ধরতে চাইছে। তার সুবিধা হল, সাহসী ও সংস্কারমুখী প্রধানমন্ত্রিত্বের জয়গান গাওয়া, যাতে ইন্দিরার প্রসঙ্গ কংগ্রেস টানতে না পারে। যদি টানে, তা হলে জরুরি অবস্থার কথা বলে পাল্টা আক্রমণ করতে পারবে বিজেপি।
রাজ্যকেন্দ্রিক নীতি
যে সব বিজেপিশাসিত রাজ্যে সামনেই ভোট, তার ফলের উপরে অনেকটাই নির্ভর করবে প্রচারকৌশল। চার-পাঁচ বার করে টানা ক্ষমতায় থাকায় প্রবল প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া বইছে। এই সব রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখাই এখন বিজেপির কাছে কঠিন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেযকরা, যদিও সে কথা মানছে না বিজেপি। মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে এখন যেনতেনপ্রকারে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে কংগ্রেস।
ছত্তীশগড়েও একই অবস্থা। গুজরাট-রাজস্থানেও বিজেপির পক্ষে আসন ধরে রাখা কঠিন। তাই তাদের নজর দিতে হবে অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলাঙ্গনা-ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গের উপরে। একই সঙ্গে উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি থেকেও তাদের যথাসম্ভব আসন পেতে হবে ক্ষমতায় থাকতে হলে। প্রতিটি রাজ্যের জন্য আলাদা নীতি তৈরি করতে হবে বিজেপিকে।
জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে লালকৃষ্ণ আডবাণী, অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদী ও অরুণ জেটলি (পিটিআই)
অসমের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হবে বলে জানিয়ে রেখেছে বিজেপি। উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে এই নীতি খাটলেও দক্ষিণে তা খাটবে না। কেরলে তারা হিন্দুত্বের তাস খেলতে পারে, আবার অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষকতাস। তেলাঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাও শেষবেলায়া বিজেপির পক্ষে যেতে পারেন, সে ক্ষেত্রে এই রাজ্যের জন্যও আলাদা নীতি স্থির করতে হতে পারে বিজেপিকে।
সোজা কথায় নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপি সামনে রাখবে ঠিকই, পাশাপাশি রাজ্যভিত্তিক নীতি ধরেও তাদের এগোতে হবে।