বাংলা নিয়ে বিজেপির প্রত্যাশা অনেক, তবে হাল এক কথায় ‘রাম ভরোসে’

রাজ্যে চতুর্মুখী লড়াইয়ে উজ্জীবিত তৃণমূল ও বিজেপি

 |  4-minute read |   18-03-2019
  • Total Shares

অবশেষে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার নির্বাচন চতুর্মুখী। সম্প্রতি দিল্লিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পরে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়ে আমার এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, রাজ্যে চতুর্মুখী লড়াইয়ের থেকে ত্রিমুখী লড়াই তাঁদের ক্ষেত্রে অনেকটাই ইতিবাচক হতে পারে।

কী  কারণে এবং কেন বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের সম্ভাব্য জোটে ভাঙন ধরল তা আলোচনা অবান্তর। কিন্তু চতুর্মুখী লড়াইটা আটকতে পারলেন না সীতারাম ইয়েচুরি। ঘটনার পরম্পরায় তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি – দুই শিবিরই উল্লসিত।

bjp_031819051934.jpgরাজ্যে চতুর্মুখী লড়াইয়ে উল্লসিত বিজেপি। (উপস্থাপনামূলক ছবি: পিটিআই)

তৃণমূল রাজ্যের শাসকদল – যে কোনও অবস্থায় তাদের উল্লাস অবান্তর নয়। কিন্তু বিজেপির উল্লাস এবং তার যুক্তিসঙ্গত কারণ এখনও ঠিক স্পষ্ট নয়।

শরীরী ভাষা এবং সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের বিজেপির এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। বিশেষ করে জাতীয় স্তরের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই প্রথম গেরুয়া শিবির আলাদা ভাবে নজর দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের দিকে। এই বিশেষ নজরের রকমভেদ আছে। কোনওটা আর্থিক, কোনওটা সাংগঠনিক, কোনওটা প্রচারকৌশল – প্রভৃতি।

কিন্তু গত বেশ কয়েকবছর ধরেই রাজ্য বিজেপির উল্লাসের প্রথম ও প্রধান কারণ হয় গুজরাটে দলের সরকার গঠন, অথবা উত্তরপ্রদেশের দলের সরকার গঠন অথবা কংগ্রেস-বামফ্রন্টের জোট হওয়া বা না হওয়া এবং সম্প্রতি তৃণমূলের তথাকথিত ভাঙন।

উল্লাসের আরও একটা কারণ – রাজ্য বিজেপি থেকে সুকৌশলে প্রচারের চেষ্টা হচ্ছে, সেটা হল, শাসক তৃণমূলের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়ে যাওয়া এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এর কোনওটাতেই সাধারণ ভোটদাতাদের এটা বোধগম্য হচ্ছে না যে এই সমস্ত কারণগুলির পিছনে রাজ্য বিজেপির সাফল্য ঠিক কোথায়!

রাজ্যের পঞ্চাশোর্ধ্ব সাংবাদিকরা, যাঁরা প্রায় গত তিন দশক ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপির নির্বাচনী উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছেন, তাঁদের কাছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সংক্রান্ত পরিবেশটি ঠিক স্পষ্ট নয়।

এমনিতেই ধরে নেওয়া হয় যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী লড়াইটা অন্য যে কোনও রাজ্যের থেকেই একেবারেই ভিন্ন ধারার। এটা যদিও ঠিক যে মানুষ যদি কাউকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলেই কোনও অঙ্ক অথবা কৌশল কার্যকরী হয় না। কিন্তু সেই পরিবেশটা তৈরি করার জন্যও একটি প্রক্রিয়া আছে। ঠিক এই জায়গাটাতেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভ্রান্ত।

arjun_031819052048.jpgমুকুল রায়ের পর উল্লেখযোগ্য হল অর্জুন সিংয়ের বিজেপিতে যোগদান। (নিজস্ব চিত্র)

দিল্লির সংসদ ভবনের ভিতরে সৌমিত্র খাঁ বা অনুপম হাজরার যাই পরিচয় থেকে থাকুক না কেন, এবং সেই পরিচয়ের সুবাদে জাতীয় স্তরে যাই প্রচার হয়ে থাকুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এই দুটো নামের যে কোনও অস্তিত্ব নেই, সে বিষয়ে রাজ্যবাসীর মনে কোনও সন্দেহ নেই।

তাই স্বয়ং মুকুল রায় এবং শেষ পর্যন্ত অর্জুন সিং ছাড়া বাকি কোনও কিছুকেই রাজ্যের মানুষ তৃণমূলের বিশ্বাসযোগ্য ভাঙন হিসাবে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা নিশ্চিত ভাবে একটা বড় প্রশ্ন।

একটু কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, বিজেপি এগিয়ে আসছে সত্যি। কিন্তু সেটা যেন রাম ভরসে... এই এগিয়ে আসের কোনও অঙ্ক আছে কিনা, থাকলে সেই অঙ্কটাকে মেলানোর জন্য চেষ্টা আছে কিনা, অথবা সেই অঙ্ক মেলানোর মতো মেধাবী ছাত্র আছে কিনা, থাকলে কতজন ছাত্র আছে – এ সব মিলিয়ে এক চরম বিভ্রান্তি।

নিশ্চিত ভাবে একটা ভালো সংখ্যক আসন পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপিকে পেতে হবে। গত প্রায় বছর দুয়েক ধরে অন্যান্য় রাজ্যের সাংগঠনিক সাফল্যের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একটা রণকৌশল তৈরির চেষ্টা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের তরফ থেকে হয়ে চলেছে। এটা ঠিক যে ত্রিপুরা ও অসমে দল ভাঙানোর একটা সুচতুর কৌশল বিজেপিকে বহু দূর এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একই ফর্মুলায় যদি সব অঙ্ক মিলে যেত তা হলে গণিতজ্ঞরা শয়ে শয়ে ফর্মুলা আবিষ্কার  করতেন না।

যে দাপটের সঙ্গে হেমন্ত বিশ্বশর্মা কংগ্রেস ভেঙে বিজেপিতে স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন, তার পুনরাবৃত্তি পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। যে অঙ্কে সুনীল দেওধর ত্রিপুরায় রণকৌশল সাজিয়েছিলেন, তার কোনও প্রতিফলন পশ্চিমবঙ্গে এখনও দেখা যায়নি।

এটা মাথায় রাখতে হবে যে, যে যোগ্যতার সঙ্গে মুকুল রায় এক সময় তৃণমূলের হয়ে শক্তি বাড়ানোর কাজ করতেন, সেই সময় বেশ কিছু অদৃশ্য শক্তি তাঁর পিছনে ঢাল হিসাবে কাজ করে এসেছে। আজ সেই ঢাল কিন্তু মুকুল রায়ের পিছনে নেই।

এমনিতেই প্রার্থীতালিকা ঘোষণা বিজেপির একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। এটা তাদের বাধ্যবাধকতা। অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে যাই হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতা আসলে সাফল্যের ক্ষেত্রে বিশাল অন্তরায়। দলীয় স্তরে এই বাধ্যবাধকতা মেনে নেওয়াল ছাড়া কোনও উপায় নেই, কিন্তু রাজ্যবিজেপির শারীরিক ভাষায় এখনও এটা ঠিক স্পষ্ট নয় যে রাজ্যের আট কোটি ভোটারের কাছে তারা তাদের ভোটার স্লিপটি পৌঁছে দিতে পারবে কিনা।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতিতে এটা একটা বড় পার্থক্য তৈরি করে, অন্তত এখনও পর্যন্ত। আর অন্তত এই জায়গাতেই প্রবীণ সাংবাদিকরা বিভ্রান্ত যাঁরা গুজরাট বা মহারাষ্ট্র বা উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে বিজেপির সাফল্য বা ব্যর্থতা কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পেয়েছেন।

তৃণমূল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ এবং তৃণমূলের ভিতরে একটি চরম অবিশ্বাসের পরিবেশ। এটি তৃণমূলের স্বাভাবিক পরিণতি। তাদের কর্মপদ্ধতি, তাদের তথাকথিত রণকৌশল ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে।

mamat1_031819052304.jpgমুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের শক্তি বাড়িয়েছিলেন মুকুল রায়। ছবি: ডেইলিও)

এখন এই সমস্ত রাম ভরোসে কারণের উপর দাঁড়িয়ে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তা এই মুহূর্তে অনুমান করতে যাওয়া খুব একটা বৈজ্ঞানিক কাজ হবে বলে মনে হয় না। বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দিকে নজর দিয়ে রেখেছে। পাঠকদের আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে আরএসএস তাদের প্রায় ১০০ বছরের ইতিহাসে শুধুমাত্র এক বার কোনও একটা বিশেষ রাজ্যের উপরে বিশেষ প্রস্তাব পাস করেছে তাদের বিশেষ বৈঠকে এবং সেই রাজ্যটির নাম পশ্চিমবঙ্গ।

তাই যাঁরা মনে করছেন যে সংসদের ভিতরে সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় এই রাজ্যের দিকে গেরুয়া শিবির নজর দিয়েছে, ঘটনাটা তা নয়। পরিকল্পনা ও নজরদারি বহু দিন ধরে চলছে এবং এই মুহূ্র্তে দাঁড়িয়ে দুটি সংগঠনেরই শীর্ষ নেতৃত্বের ধারনা, তাঁরা সাফল্যের প্রাথমিক সাফল্যের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন।

কিন্তু এখনও আমার ধারনা, পুরোটাই রাম ভরোসে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

PRASENJIT BAKSI PRASENJIT BAKSI @baksister

The writer is a veteran journalist.

Comment