ভুটানের সাধারণ নির্বাচন কেন ভারতকেও চিন্তায় রাখছে
থিম্পুতে ক্ষমতা পরিবর্তন মানেই ভুটান চিন সমর্থক হয়ে পড়বে না, ভারত কিন্তু সতর্ক
- Total Shares
ভুটানের জাতীয় নির্বাচনের প্রাথমিক পর্যায়ের ফলাফল যথেষ্ট অবাক করে দেওয়ার মতো। প্রাথমিক পর্বে শাসক দল রীতিমতো নাকানি-চোবানি খেয়ে সবকটি প্রতিদ্বন্ধি দলগুলোর মধ্যে তিন নম্বরে শেষ করেছে।
সে দেশে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ২০০৭ সালে একটি প্রতীকী নির্বাচনের মাধ্যমে ভুটানের জনগণকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে সড়গড় করা থেকে এ বার ভুটানের ইতিহাসে তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
এবার ভুটানের জনগণ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলী তথা নিম্নকক্ষের জন্যে মোট ৪৭ জন সদস্যকে বেছে নেবেন। দেশের উচ্চকক্ষ তথা ন্যাশনাল কাউন্সিলে মোট ২০টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনকে নির্বাচন করা হয় আর বাকি পাঁচজনকে রাজা মনোনীত করেন।
দুই পর্যায়ে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে সবকটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এই পর্যায়ের যে দুটি এক ও দুই নম্বরে রয়েছে শুধুমাত্র সেই দুটি দল পরবর্তী পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে।
এ বছর ১৭ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই পর্যায়ের ফলাফল প্রকাশের পর জানা যাচ্ছে যে শাসক দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টিকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ড্রুক ন্যামরূপ সোগপা (ডিএনটি) ও ড্রুক ফুনসেম সোগবা (ডিপিটি)। এর ফলে, পরবর্তী পর্যায়ে ডিএনটি ও ডিপিটি মুখোমুখি হতে চলেছে।
লোটে শেরিং বলে জনৈক চিকিৎসক ডিএনটির নেতা। তিনি স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির কথা বলে এই নির্বাচনে লড়াই করছেন। ডিএনটির এখনও অবধি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে ডিএনটি ১৬টি আসনে জয়লাভ করেছে। উল্টোদিকে, ২০১৩ সালের নির্বাচনের ফলা প্রকাশের পরন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীতে ডিএনপির ১৫জন সদস্য রয়েছে।
ভুটানের এবার তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে [ছবি: রয়টার্স]
ভারত ও চিন তথা সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো এখন ভুটানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হয় তা জানার জন্যে মুখিয়ে রয়েছে। ডোকলাম নিয়ে ৭৯ দিন মতো অচলবস্থা চলার পর এখন ভুটানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী এখন কোন শিবিরের দিকে হেলবেন তা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিন এর আগে ডোকলাম সহ আরও বেশ কিছু ভুটান লাগোয়া সীমান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এরকম শোনা যায় যে ডোকলামের ১০০ বর্গকিমি জায়গাটির পরিবর্তে চিন নাকি ভুটানকে অন্য কোনও এলাকা বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
১৯৪৯ সালের ইন্দো-ভুটান চুক্তি অনুযায়ী ভুটানকে বিদেশ-বিষয়ক কোনও সিদ্ধান্ত ভারতের পরমার্শ মেনেই নিতে হবে। ২০০৭ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী জাতীয় স্বার্থে দুটি দেশই একে ওপরকে সহযোগিতা করবে। ডোকলাম অচলাবস্থার সময় ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে কিন্তু ভারতের পক্ষেই ছিল। সেই সময় ভুটান সরকারের তরফ থেকে এক বিবৃতিতে পরিষ্কার বলা হয়েছিল যে চিন ভুটানের এলাকা দখল করে রয়েছে।
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরেও ভুটানের রাজনীতি কিন্তু রাজনতন্ত্রকেও যথেষ্ট সম্মান করে থাকে। ভারতের কাছে দুই দেশের সম্পর্ককে মজবুত রাখতে পারাটা কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই মুহর্তে রাজপরিবার ছাড়াও ভারতের উচিত ডিএনটি ও ডিপিটি নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। শেষ পর্যায়ের নির্বাচনের ফলাফল যায় হোক না কেন, এবার থেকে ভুটান নীতি তৈরি করার দায়িত্ব কিন্তু এই দুই দলের উপরই বর্তাবে।
থিম্পুতে ক্ষমতা বদল মানে এই নয় যে ভুটান রাতারাতি চিন সমর্থক হয়ে উঠবে। বরঞ্চ, ভুটান চেষ্টা করবে ভারত ও চিন দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক মজবুত করতে। এত দিন অবধি ভুটানের উপর দিল্লিরই একচেটিয়া প্রভাব ছিল। অধিকাংশ সময়তেই ভুটানকে ভারতের পাশে থাকতে দেখা গিয়েছে।
থিম্পুতে ক্ষমতা বদল মানে ভুটান চিনের সমর্থক হয়ে উঠবে এমনটা নয় [ছবি: পিটিআই]
কিন্তু যে ভাবে সৌভ্রাতৃত্বের চুক্তি আবার নতুন করে তৈরি করা হল তাতে দুই দেশের সম্পর্কের যে কিছুটা অবনতি ঘটেছে তাই প্রমান করে।
নেপালের উপর একচেটিয়া অধিকার হারাবার পর ভারতের উচিত ভুটানের ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি না হতে দেওয়া। চিন ভারতের সামর্থ্যের থেকে বেশি ভুটানকে দিতে চাইবে। কিন্তু এই মুহূর্তে হয়ত ভুটানের অতটা বিনিয়োগের প্ৰয়োজন পড়বে না।
জিডিপির থেকেও মানুষের সুখ স্বচ্ছন্দ্য যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই বার্তাটি গোটা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চাইছে ভুটান। সম্প্রতি, ভুটান-বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল যানবাহন চুক্তিতে সায় দেয়নি ভুটান। এই চুক্তি ফলপ্রসূ হলে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুতের প্রক্রিয়া আরও সহজ হত।
দেশের জনগণের একাংশ পরিবেশগত কারণের জন্যে এই প্রকল্প চায় না। তাই এই প্রকল্পে ভুটানের সায় ছিল না। সুতারং, ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে এই মুহূর্তে চিনের বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে ভুটান লালায়িত নয়। সে দেশে ব্যাপক হারে শিল্পায়ন ভুটানের কাছে অগ্রাধিকার নয়।
ভারত ভুটানের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনটাও বেশ সুপ্রাচীন [ছবি: রয়টার্স]
যদিও গোটা বিশ্বের মতোই ভুটানের তরুণরাও ভালো চাকরি বা উন্নতমানের জীবনযাপনের আশা করে। তাই ভারতের উচিত ভুটানকে এমনভাবে সাহায্য করা যাতে সে দেশের নাগরিক সরাসরি উপকৃত হয়।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, কৃষি ও পর্যটনশিল্পের উপর জোর দেওয়া উচিত ভারতের। ইতিমধ্যেই, ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ রপ্তানি করে ভারত এবং ভুটানে আরও কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভারত। ভুটান ভারতকে জলবিদ্যুৎ বিক্রি করে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি করে। সংস্কৃতির দিক থেকেও দুই দেশের প্রচুর মেলবন্ধন রয়েছে।
আগামী দিনে একটি সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র হিসেবে ভুটান আরও বেশি করে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে চাইবে। তাই ভুটানকেও আরও পাঁচটি দেশের মতো সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।