এই বাংলায় শুধু আছে ভাষণ, শুধু আছে চমক, শুধু আছে প্রতিশ্রুতির বন্যা
বিরোধী রাজনীতি করা অপরাধ, একশো দিনের কাজ বেশি মানেই তো অনুন্নয়ন
- Total Shares
বাংলায় পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার মানুষের অনেক আশাপ্রত্যাশা ছিল। সেই ডাকে আমরাও সামিল হয়েছিলাম। কাঙ্ক্ষিত সেই পরিবর্তন হয়, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। তারপর পশ্চিমবঙ্গে খুব দ্রুত যেন অবক্ষয়ের যুগ শুরু হয়ে গেল। যেটা কিন্তু বাংলার মানুষের আমাদের প্রতি প্রত্যাশা ছিল না।
আমরাও চেয়েছিলাম বাংলার অগ্রগতি হোক, বাংলার উন্নয়ন হোক, বাংলার শুভ হোক, বাংলার মঙ্গল হোক। কিন্তু ঘটনা যে দিকে যাচ্ছে তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যেন ক্রমশ বাংলায় একটা রাজনৈতিক অবক্ষয়ের জমানা শুরু হয়ে গেল।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ বাংলার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল। যে পরিচয়ে ঘুন ধরেছিল বামের আমলে, সে পরিচয় সম্পূর্ণ নষ্ট হচ্ছে অবক্ষয়ের মাধ্যমে, তৃণমূলের আমলে, যেখানে বিরোধী রাজনীতি করাটা অপরাধের নামান্তর হয়ে যাচ্ছে। বাংলার তৃণমূলনেত্রী বাংলায় এই যে সংস্কৃতিটা তৈরি করলেন, জানি না এর ফল কতটা সুদূরপ্রসারী হবে, কারণ যতদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন কিন্তু এই সংস্কৃতি বজায় থাকবে, যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এক সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক আগ্রাসন শুরু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রামনবমী বিজেপি পালন করবে, তাকে টক্কর দিতে সরকারি দল রামনবমী করতে আরম্ভ করল
পরিণামে কী হচ্ছে? পরিণামে বাংলায় রাজনীতির মূল্যবোধ অপসৃয়মান, সেই সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর বিরোধী-শূন্য, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি দুর্বল করার মধ্য দিয়ে বিরোধীশূন্য যে পরিসর তৈরি করার চেষ্টা করলেন, সেই পরিসরকে নির্ভর করে বাংলায় বিজেপির উত্থান হতে লাগল।
বামেরা, কংগ্রেসিরা নিশ্চয়ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও রাজনৈতিক শত্রুর মধ্যে যে স্পষ্ট বিভাজন, সেটা তৃণমূল মুছে দিল।এখানে প্রতিপক্ষ হয়ে গেল শত্রু। বাংলায় এই যে ধর্মনিরপেক্ষ পরিসর, সরকারি দল তৃণমূল ছাড়াও অনেকে ছিল, এখন তা সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ায় বিজেপি, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো অপরিচিত সংগঠনগুলো ক্রমশ পরিচিতি লাভ করছে। অপ্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক কতকগুলো প্রতিষ্ঠান আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রাসঙ্গিক হচ্ছে এবং তাদেরকে রুখতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাম্প্রদায়িকতা রোখার জন্য আরও বড় সাম্প্রদায়িক হতে হবে, এই তত্ত্ব অবলম্বন করছেন।
জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ হতে গিয়ে যেমন অতি জাতীয়তাবাদ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিপক্ষ হতে গিয়ে অতিসাম্প্রদায়িক রাজনীতি অবলম্বন করার মধ্য দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরেকটা রাজনৈতিক বোকামি করছেন।
বাংলায় শিল্পস্থাপনের জন্য ভবিষ্যৎ কোনও দিশা বাংলার বেকার যুবকদের দেখানো সম্ভব হয়েছে?
রামনবমী বিজেপি পালন করবে, তাকে টক্কর দিতে সরকারি দল রামনবমী করতে আরম্ভ করল। রামকে সবাই আমরা শ্রদ্ধা করি, রাম-রহিমের ফারাক বাংলার জনগণ করেনি। কিন্তু আজ রাম কার, তা নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বিজেপি বলছে রাম আমার, মমতা বলছেন, রাম আমারও। কিন্তু রাম তো সবার। বাংলার রাজনীতিতে রাম ছিল সবার।
এ বাংলায় আমরা বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শের দ্বারা বড় হয়েছি। এ বাংলায় আমরা রাম-রহিমের মধ্যে কখনও বিভাজন করতে শিখিনি। এ বাংলায় রাম আমার, রাম তোমার, রামের উপরে অধিকার নিয়ে দুই দল ময়দানে অবতীর্ণ-- এ অভূতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য, যার সঙ্গে বাংলার মানুষ পরিচিত ছিল না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন ‘উন্নয়ন করছি।’ উন্নয়নের সংজ্ঞা কী? মানুষের জীবনে রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক-- সমস্ত বিষয়গুলোকে সুরক্ষিত করার নাম তো উন্নয়ন। আজকে উন্নয়নের ঢোল বাজিয়ে দিল্লির সরকারের প্রকল্পগুলোকে নাম বদল করে তিনি বাংলার উন্নয়ন করছেন বলে কৃতিত্বের ধ্বজাকে তুলে ধরে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের উত্থানের সোপান হিসাবে গ্রহণ করলেন। আসলে এই বাংলায় কি কোনও উন্নয়ন হচ্ছে প্রকৃত অর্থে? মানুষের মাথাপিছু আয় কি বাড়ছে? বাংলায় কি শিল্প হচ্ছে? বাংলায় কি রুটি-রুজির কোনও নতুন নতুন পথ খুলেছে? বাংলায় শিল্পস্থাপনের জন্য ভবিষ্যৎ কোনও দিশা বাংলার বেকার যুবকদের দেখানো সম্ভব হয়েছে? তা হলে উন্নয়নটা কিসের?
মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন, কেন একশো দিনের কাজ এখানে বেশি হয়েছে? একশো দিনের কাজ বেশি হওয়া মানেই তো অনুন্নয়ন। যদি বলেন কেন? আজকে মানুষ ১০০ দিনের কাজের জন্য কেন প্রতিযোগিতা করছে? তার কারণ, তাঁর কাছে বিকল্প নেই। একশো দিনের কাজে ক’টাকা পান একজন? ১৭০ থেকে ১৭১ টাকা। বছরে ১০০ দিন কাজ দেওয়ার আইন আছে। একজন লোককে বছরে ১০০ দিন কাজ দেওয়া হলেও তিনি কত টাকা পাবেন ১৭০ টাকা হিসাবে? মনে করুন ১৭,০০০ টাকা। মাসে কত? দেড় হাজার টাকারও কম।
আমরা কৃতিত্ব নিচ্ছি ১০০ দিনের কাজের। ২০০৬ সালে কংগ্রেস জমানায় সারা ভারতে আমরা এই কাজ চালু করেছিলাম, যাতে অভাবের সময়ে মানুষকে কিছুটা সাহায্য দেওয়া যায়। এগুলো প্যালিয়েটিভ মেজার (উপশমকারী ব্যবস্থা)।অভাবের সময় মানুষের কাজ থাকে না, চাহিদা বাড়ে। তাই প্রয়োজন অনুসারী চাহিদা হিসাবে যাতে লোকে সহযোগিতা পান, এই মানসিকতা নিয়ে তৈরি হয়েছিল একশো দিনের কাজ।
আজ এই একশো দিনের কাজকে হাতিয়ার করে বলছেন বাংলায় উন্নয়ন হয়ে গেল
আজ এই একশো দিনের কাজকে হাতিয়ার করে বলছেন বাংলায় উন্নয়ন হয়ে গেল। বাংলার মানুষের যদি বেশি অর্থ রোজগার করার সুযোগ থাকত, তা হলে তিনি একশো দিনের কাজ করতে যাবেন কেন? তার মানে তো প্রমাণ হচ্ছে বাংলায় বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেই! তাই দিনে ১৭০ টাকা রোজগারের জন্য আমি হাপিত্যেশ করছি।
আর কী হচ্ছে? বাংলার মানুষ এখন সারা ভারতের সস্তার শ্রমিকশ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। কাজের জন্য চলে যাচ্ছেন কেরল, মহারাষ্ট্র, গুজরাট... কেননা সেখানে মজুরি বেশি, লাভ বেশি। অর্থাৎ বাংলা থেকে শ্রমজীবী মানুষের, বেকার মানুষের পলায়ন হচ্ছে। এবং খুব দ্রুত গতিতে বাংলা থেকে বড় মাইগ্রেশন (স্থানান্তর) ঘটছে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে, যেখানে মজুরি বেশি, যেখানে কর্মের সুযোগ বেশি। একটা সময় ছিল যখন বাইরের রাজ্য থেকে বাংলায় মানুষ আসতেন কর্মের জন্য আর আজ কর্মের জন্য বাংলার মানুষ বাইরের রাজ্যে চলে যাচ্ছেন।
এই অভিবাসন শুধু কর্মের জন্য নয়, বাংলা থেকে পুঁজিও আজ বাইরে চলে যাচ্ছে। বাংলা থেকে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার পুঁজিরও স্থানান্তর ঘটেছে। বাংলার শিল্পপতিদের বসবাসের ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ হলেও তাঁরা পুঁজি বিনিয়োগ করছেন অন্য রাজ্যে। আপনারা দেখতে পারেন, তথ্য নিতে পারেন।
এই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী প্রতি বছর শিল্প সম্মেলন করছেন, বাংলার বেকার যুবকদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সোনালি স্বপ্ন, রঙিন স্বপ্ন। পরপর চার বার শিল্প সম্মেলন হল। তাতে আমি হিসাব করে দেখলাম, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নিজের বয়ান অনুযায়ী শিল্পে প্রায় সাড়ে নয় থেকে দশ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ হওয়া উচিৎ। সেই পুঁজি কোথায় বিনিয়োগ হল, তার দ্বারা বাংলায় কোথায় কর্ম সৃষ্টি হল? একের পর এক শিল্প বন্ধ হল বাংলায়, নতুন কোনও শিল্প খোলার কোনও চিহ্ন নেই।
মানুষের অভাব আছে, সেই অভাবটাকেই তিনি রাজনৈতিক পুঁজি করতে চাইছেন। মানুষের অভাব দূর করে নয়, মানুষের অভাব বাঁচিয়ে রেখে তাঁদের শুধু বাঁচার মতো ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে খরিদ করে নাও। অর্থাৎ বাংলার অভাবটাই এখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক পুঁজি। অভাব দূর করার জন্য নয়, তাঁকে স্বয়ং-সম্পূর্ণ করার জন্য নয়, তাঁর অভাবটাকে বাঁচিয়ে রেখে তিনি বাংলায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সকলকে ভাবতে হবে।
বাংলায় শিল্প নেই, এই বাংলায় রুটিরুজির ব্যবস্থা নেই, এই বাংলায় শিক্ষা নেই, এই বাংলায় শুধু আছে ভাষণ, শুধু আছে চমক, শুধু আছে প্রতিশ্রুতির বন্যা, তাই বাংলার মানুষকে আগামী দিনে ভাবতে হবে, বুঝতে হবে, জানতে হবে।