পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি: অতি 'তুচ্ছ' একটি দল থেকে আজ রাজ্যের মুখ্য বিরোধী দল

মমতা ফিরলেন তাঁর চির প্রসিদ্ধ 'ধর্ণা' রাজনীতিতে, এর থেকেই প্রমাণিত যে তৃণমূল নেতৃত্ব চাপে রয়েছে

 |  5-minute read |   06-02-2019
  • Total Shares

কলকাতায়, টেলিগ্রাফ পত্রিকায়, আমি আমার সাংবাদিক জীবন শুরু করি।

সেই সময়কার (২০০০ সাল) পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন ছিল। বেশ একটি অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতি চলছিল গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। একজন নবীন সাংবাদিক হিসেবে খুব কাছ থেকে সেই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করি আমি।

রাজ্যে তখন বাম শাসন। বামসরকারকে গদিচ্যুত করার মতো কোনও বিরোধীকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর পাশাপাশি রাজ্য জুড়ে নিয়মিত হরতাল লেগেই থাকত।

বন্ধ হওয়া বা প্রায় বন্ধ হতে চলা কলকারখানাগুলোতে (বিশেষ করে পাট কারখানাগুলোতে) হিংসা প্রায় দৈনন্দিন হয়ে উঠেছিল। সে সময়কার একটি ঘটনার কথা আমার আজও মনে পড়ে। উত্তর ২৪ পরগনার বরাহনগরের এক পাট কারখানার ম্যানেজার আন্দোলরত এক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছিল। এর পর সেই ম্যানেজার ও তার সহকর্মীদের উপর চড়াও হয় কারখানার অন্যান্য কর্মচারীরা।

body_020619012216.jpgএকদা পশ্চিমবঙ্গে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনন্দিন হয়ে উঠেছিল [ছবি: পিটিআই]

সেই খবর সংগ্রহ করতে সেদিন আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম।

পরের দিন আবারও আমি ঘটনাস্থলে যাই একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন তৈরি করতে। পরের দিন প্রথম পাতায় আমার সেই খবর প্রকাশিত হয়। আমি আজও বিশ্বাস করি যে আমার সেদিনের সেই প্রতিবেদনে কোথাও কোনও আবেগ ছিল না। কিন্তু বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গের যা পরিস্থিতি ছিল যে যখনই কোথাও কোনও হিংসার ঘটনা ঘটত এবং খবর সংগ্রহের জন্য আমাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হত আমি কেমন যেন মর্মাহত হয়ে পড়তাম। ঘটনার দিনের খবর করা থেকে পরের দিনের তদন্তমূলক প্ৰতিবেদন লেখাটা আরও বেদনাদায়ক ছিল।

ঘটনার দিনে আমার বেশি করে ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য আদায়ের উপর মনোনিবেশ করতাম। কিন্তু পরের দিন 'ভিতরকার' খবর বের করতে গেলেই আমি বেশ বিষণ্ণ হয়ে পড়তাম।

ঘটনার পরের দিনের খবর মানেই ঘটনাস্থলে কিংবা ঘটনায় মৃত পরিবারের বাড়িতেযেতে হবে। মৃতের দেহের পাশে বসা আত্মীয় পরিজনদের কান্না বা চোখের জল দেখতে কারই বা ভালো লাগে। আর, এরই ফাঁকে তাদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার সূত্রপাত কী ভাবে বা কী থেকে হয়েছিল তা আমাকে জেনে নিতে হত।

একেবারে সামনে থেকে বামপন্থী হিংসা দেখার অভিজ্ঞতা আমার জীবনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। সেই সময়ে আমি প্রায়ই প্রার্থনা করতাম এই শাসনের যেন দ্রুত অবসান ঘটে। কিন্তু সে সব দিনে রিপোর্টারদের কাজ ছিল অনেকটা পোর্টার, মানে কুলিদের, মতো। তারা শুধু খবর বহন করে নিয়ে অফিস যেত। খবরটা কী ভাবে ছাপা হবে সে বিষয়ে তাদের মতামত দেওয়ার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। এই নিয়ম আজও বহাল রয়েছে।

কিন্তু সে সব দিনে আদর্শগত দিক থেকে সংবাদমাধ্যমগুলোতে এতটা ভেদাভেদ ছিল। সুতারং এই ধরণের হিংসা কিংবা গণতন্ত্রকে হত্যা করার চক্রান্ত দেখা দিলেই সংবাদমাধ্যম এক যোগে সমালোচনা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমই বাম-বিরোধী খবর করত (হাতে গোনা একটি কী দুটি বাদে)।

বাম নেতাদের অধিকাংশই বর্ষীয়ান ছিলেন আর তাই তাঁরা আমাদের মতো নবীন সাংবাদিকদের শিক্ষানবিশ ভেবে মাঝে মধ্যেই 'জ্ঞান' সরবারহ করতেন। আমাদের সিনিয়র রিপোর্টারদের (বিশেষ করে রাজনৈতিক সাংবাদিকদের) তাঁরা প্রায়শই বলতেন, "ছোটদের ঠিক করে তৈরি কর'। তখন ঠিক বুঝতাম না যে এই বাম নেতারা ঠিক কী বলতে চাইছেন। এখন বুঝতে পারি। আমি যখনই তাঁদের বিভিন্ন অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতাম তখন তাঁদের কাছে আমার বাম বিরোধী মনোভাবটা প্রকট হয়ে যেত।

body1_020619012329.jpg২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পাত্তা পেত না, সেই বিজেপিই আজ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল [ছবি: পিটিআই]

তাঁরা আমাকে পছন্দ করতেন না - তাই তাঁরা ভাবতেন আমাকে ঠিক মতো তৈরি করা হয়নি।

তবে, সেই সময়ে সাংবাদিকতা করার মজাটাই ভিন্ন ছিল। কারণ, আপনি সরসরারি শাসকদের সত্যি কথাটা বলতে পারতেন।

একজন নবীন সাংবাদিক হিসেবে আমার উৎসাহের কোনও অন্ত ছিল না। আমার সিনিয়ররা যখন খবর করার দিকে ব্যস্ত থাকতেন তখন আমি বিরোধী কণ্ঠের খোঁজ করে চলতাম।

আর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই কণ্ঠ বিজেপির কণ্ঠ হত।

২০০০-০১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি খুব একটা পাত্তা দেওয়া হত না।

বিজেপি নেতাদের মতামত কালেভদ্রে কাগজের পাতায় স্থান পেত। অনেকে সময়েই আমার খবর যখন কাটাছেঁড়া করা হত তখন বিজেপির উক্তিই সবার আগে বাদ পড়ত। সে সময়ে সত্যিই পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের কাছে বিজেপির খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।

শুধুমাত্র যখন দিল্লি থেকে কোনও জনপ্রিয় বিজেপি নেতা কলকাতা যেতেন তখন ফলাও করে সংবাদমাধ্যমে বিজেপির খবর প্রকাশিত হত।

সেই সময়কার কোনও রাজনৈতিক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করে দেখুন তাঁরা সকলেই একই কথা বলবেন - সে সময়ে কেউই স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে বিজেপি একদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য বিরোধী দল হয়ে উঠবে আর রাজ্য রাজনীতিতে থেকে বামফ্রন্ট প্রায় হারিয়ে যাবে।

এবার ২০১৯-এ আসুন। বিজেপি এখন বর্তমান শাসক দলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে চলেছে। মনে হচ্ছে তৃণমূলকে গদিচ্যুত করতে একমাত্র বিজেপিই পারে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখছেন। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব (যেমন বাবুল সুপ্রিয়) কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রয়েছেন।

একেবারে 'অর্থহীন' একটি দল থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য বিরোধী দল হয়ে ওঠার জন্য অনেকটা পথ চলতে হয়েছেন বিজেপিকে।

body2_020619012410.jpgবিজেপি বেশ চাপে রেখেছে শাসক দল তৃণমূলকে [ছবি: পিটিআই]

শেষ দু'দশকে দলটি ও দলটির নেতৃত্বে বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।

এই মুহূর্তে, পশ্চিমবঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিজেপি।

বিজেপি যদি ঠিকঠাক খেলতে পারে তাহলে তৃণমূল গদিচ্যুত হতে পারে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩ বছর বাদে আবার তাঁর চিরপ্রসিদ্ধ 'ধর্ণা' রাজনীতি নিয়ে পথে নেমেছেন। তৃণমূল নেতৃত্বের উপর বিজেপি যে চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে তার কিন্তু আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

এখান থেকেই বাংলা জয়ের পথটা তৈরি করতে পারে বিজেপি। আবার, তৃণমূলের পথ ধরেই তৃণমূলকে পরাস্ত করার কথা চিন্তা ভাবনা করতে পারে বিজেপি।

পশ্চিমবঙ্গে আবার পরিবর্তনের সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। সেই পরিবর্তন সম্ভব হবে কিনা তা কিন্তু বিজেপির পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোর উপর অনেকটাই নির্ভর করছে।

আর, এই প্রতীকী যুদ্ধটাই তেসরা ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হয়ে গেল।

এই যুদ্ধে যে জয়ী হবে বাংলা তার দখলেই থাকবে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000
Comment