তদন্তই হচ্ছে না মৃত্যুর, ছক বাঁধা গতে সবই নিছক আত্মহত্যা বলছে প্রশাসন
এ রাজ্যে নিরপেক্ষতার কোনও স্থান নেই, সাহসীরা এখন একঘরে
- Total Shares
প্রিসাইডিং অফিসার শিক্ষক রাজকুমার রায়ের মৃত্যু থেকে ‘আত্মহত্যা’ শুরু। ময়নাতদন্তের আগেই, তদন্ত করার আগেই এমনকি মৃতদেহটি পর্যন্ত দেখার আগেই বলে দেওয়া হচ্ছে আত্মহত্যা।
ছক বাঁধা গতে সবই নিছক আত্মহত্যা। তৃণমূলের সরকারে যে গুণ্ডামি চলছে, মস্তানি চলছে, বিরোধীশূন্য করার জন্য পুলিশ প্রশাসন, সাধারণ প্রশাসন, তৃণমূলের মস্তান, গুণ্ডা এবং নেতা-মন্ত্রী মায় মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে গত এক বছর ধরে উঠেপড়ে লেগেছিলেন এ সব তারই ফল। ছক বেঁধে সরকারি খরচায় সরকারি সভা করে বলা হয়, সিলেকশন (মনোনয়ন)হবে, ইলেকশন (নির্বাচন)হবে না। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, “আমার ১০০ শতাংশই চাই।”
মুখ্যমন্ত্রী এটা বলার মানে হচ্ছে, জেলাশাসক, পুলিশসুপার, মহকুমাশাসক, ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক এমনকি রাজ্য নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত সকলের কাছে বার্তা দেওয়া --এটা হচ্ছে সরকারের ইচ্ছা, দলের ইচ্ছা নয়। সুতরাং, তৃণমূলের ইচ্ছাকে সরকারের ইচ্ছায় পরিণত করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে গণতন্ত্রের উপরে গত সাত বছর ধরে যে আক্রমণ হচ্ছে—যেমন বিরোধীদের অফিসকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, দখল করে নেওয়া, শহিদবেদী গুঁড়িয়ে দেওয়া, পতাকা-স্তম্ভ ভেঙে দেওয়া, মিটিং-মিছিল ও সভা করতে না দেওয়া, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন সংস্থা, যেখানে তৃণমূল ছাত্রসংদ ও তৃণমূলের সংগঠন ছাড়া অন্য কোনও সংগঠন না করতে দেওয়া প্রভৃতি—তাই চূড়ান্ত রূপ পেল। এটারই পরিণতি হচ্ছে পঞ্চায়েতকে বিরোধীশূন্য করা।
যাঁরাই নিরপেক্ষ তদন্ত করতে গেছেন তাঁরাই একঘরে হয়ে গেছেন
এটা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। কারণ হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। একশো দিনের কাজে, আবাসন প্রকল্পে, সরকারের শ্রী-যুক্ত ও শ্রী-বিযুক্ত যে সব কর্মসূচি আছে সবেতেই দুর্নীতি। সেই সব প্রকল্পগুলোর বিলি-বন্দোবাস্ত নিজেরাই করবে তৃণমূল। প্রশাসন ও তৃণমূলের এই কেড়ে খাওয়া, মেরে খাওয়া ও পেড়ে খাওয়ার যে দল তাদের স্বার্থে ও তাদের জন্য বন্দোবস্ত পাকা করতে এবং একই সঙ্গে নিজের পদকে নিষ্কণ্টক করার জন্যই পঞ্চায়েতকে বিরোধীশূন্য করতে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ বার মনোনয়ন জমার আগে থেকে ভোটের ফল প্রকাশের পর পর্যন্ত কোনও নিয়ম-নীতি-প্রক্রিয়া মেনে চলেননি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার থেকে পুলিশ ও রিটার্নিং অফিসার এবং বিডিও—কেউই। যার ফলে সব স্তরেই গণ্ডগোল হয়েছে। তার পরেও হিসাব মেলাতে না পেরে ভোটের গণনাকেন্দ্রেও ছাপ্পা ভোট দেওয়া হয়েছে। একদিকে গণনা হচ্ছে, অন্য দিকে ব্যালট পেপারে ছাপ মারা চলছে। বাইরে তো এখন অসংখ্য ব্যালটপেপার ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী এ সব স্বজ্ঞানে, সচেতন ভাবে করেছেন বলে কোনও তদন্ত করা তো দূরের কথা, কোনও অভিযোগ নিতেও অস্বীকার করছে প্রশাসন। এ বার যাঁরা যেখানে বাধা দিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যাঁরা যেখানে নিয়ম মেনে কাজ করতে চাইলেন, যে মানুষ ভোট দিতে গেলেন, যে প্রার্থী বা তাঁর এজেন্ট টিঁকে গেলেন শেষ পর্যন্ত, এবং এত ভোট লুঠের পরেও জিতে গেল বা ব্যাপক ভাবে প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকলেন, এখন বেছে বেছে তাদের উপরে আক্রমণ হচ্ছে। সেটা করতে গিয়ে প্রশাসন নিজেকে উলঙ্গ করছে।
এই ধরনের ঘটনা অভিযোগ উঠলে নির্ভরযোগ্য নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হয়। পুলিশ, সিআইডি, জেলা প্রশাসন নিরপেক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। যার ফলে কোনও তদন্ত করার আগে ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে এটা আত্মহত্যা।
দিল্লির সঙ্গে বোঝাপড়া থাকার জন্যই তৃণমূলের কংগ্রেসের এত বাড়বাড়ন্ত
কোচবিহারে ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে আলতাবের। সে তো আহত। এই ঘটনাতো তো অস্বীকার করা যাবে না। এই অবস্থায় গণমাধ্যমের একটা অংশ পুরো ঘটনাকে রঙীন চশমায় দেখার চেষ্টা করছে।
We salute Ramjan Mian killed by the TMC goons,buried today when Ramjan is observed by our CM too. Will she ensure peace atleast in this month of Ramadan and happy Id in the state? pic.twitter.com/Ezlr0vSekc
— Surjya Kanta Mishra (@mishra_surjya) June 4, 2018
সারা রাজ্যে যখন এ সব চলছে তখন গণমাধ্যমও ‘স্পনসর্ড আইটেম’ হিসাবে ভাগাড় কাণ্ড চালাচ্ছিল। যখন গোটা রাজ্যটাকে ভাগাড় বানাচ্ছেন মমতা, তখন প্রচারে যাতে এই খুনোখুনি-মারামারি-হত্যা-আক্রমণ-লুঠ যাতে না আসে সে জন্য অন্য একটি বিষয়ের দিকে তারা নজর ঘোরাচ্ছিল। এখন ভোট শেষ, ভাগাড় শেষ।
যখন বিজেপির কেউ খুন হচ্ছে তখন যেহেতু তা নাগপুর থেকে বা বিজেপি সদরদপ্তর থেকে বেরচ্ছে, জাতীয়স্তরের গণমাধ্যমগুলো তখনই সেটা প্রচার করছে। কিন্তু প্রতিদিন গ্রামবাংলায় যে আক্রমণ হচ্ছে এবং বিরোধীশূন্য করার জন্য যে হত্যা হচ্ছে, ঘর জ্বালাচ্ছে, ঘরছাড়া হচ্ছে এবং মিথ্যা মামলা হচ্ছে, এমনকি কোনও মহিলা যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে থাকেন, তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার করে তাঁকে হয় দল ছাড়তে না হয় শংসাপত্র ফেরাতে বলা হচ্ছে, না হলে স্বামীকে ছাড়া হচ্ছে না। মানে পদত্যাগ কর অথবা দলত্যাগ কর। সেই খবর একনও মিডিয়াতে আসছে না। কারণ তাঁরা কেউই গ্রামের প্রত্যন্ত জায়গায় যাচ্ছেন না।
তৃণমূলের লোক জিতেও গ্রামে ঢুকতে পারছে না, এমন উদাহরণও আছে। এর একটা কারণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। আরেকটা ব্যাপারে আমাদের কাছে উদাহরণ রয়েছে, মানুষ বলছে, “আমরা ভোট দিলাম না, তার পরে তুমি কোথা থেক জয়ের শংসাপত্র নিয়ে এলে?” এই যে মানুষের রোষ এটা আরও বাড়বে। কিন্তু সরকার-বিরোধী, প্রশাসন-বিরোধী, পুলিশ বিরোধী এবং তৃণমূল-বিরোধী এই যে মানুষের রোষ, তাকে কেউ কেউ জাত-পাত বা ধর্মের নামে ভাগ করার চেষ্টা করছে। তারা কিন্তু আসলে তৃণমূল-বিরোধী মানুষের এই রোষকে বিভাজিত করে, দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। তাতে আখেরে লাভ হচ্ছে তৃণমূলেরই।
তৃণমূলের লোক জিতেও গ্রামে ঢুকতে পারছে না, এমন উদাহরণও আছে
আমরা চাই ব্যক্তিহত্যার যে সব অভিযোগ আছে তা যেন লিপিবদ্ধ হয়, নির্ভীক এবং নিরপেক্ষ তদন্ত হয় এবং সেটা করার জন্য বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরযোগ্যদের দিয়ে, দরকারে এসআইটি তৈরি করতে হবে। এখনও অনেক আধিকারিক আছেন, নিঃসন্দেহে যাঁরা ভালো। কিন্তু যাঁরাই নিরপেক্ষ তদন্ত করতে গেছেন তাঁরাই একঘরে হয়ে গেছেন। এখানে সিবিআই এবং সিআইডি উভয়েই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আজ পর্যন্ত ইডি, সিআইডি, সিবিআই নারদ-সারদা কাণ্ডে চিটফাণ্ড কাণ্ড উপরের সঙ্গে বোঝাপড়ায় মিটমাট হয়ে গেছে।
দিল্লির সঙ্গে বোঝাপড়া থাকার জন্যই তৃণমূলের কংগ্রেসের এত বাড়বাড়ন্ত। তারা মনে করছে, দিল্লিকে ম্যানেজ করে নিয়েছি, তাই সাত বছরে আগে কোনও দিন এত মরিয়া হয়ে ওঠেনি। প্রশাসন এত বেশি দলদাস হয়নি। প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকরা আইনের ভূমিকা, প্রশাসনিক নির্দেশিকা, প্রোটোকল, স্টান্ডার্ড প্রসিডিয়োর সরিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ হয়েছেন, কারণ তাঁরাও জানেন যে তাঁর মাথাতেও কারও কারও হাত রয়েছে।