কৌশলী পদক্ষেপ: কেন বালাকোটের বিমানহামলা এত গুরুত্বপূর্ণ?
এটাই ছিল ভারতে হামলা করার পরিকল্পনা, আত্মঘাতী হামলার প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার ঘাঁটি
- Total Shares
২৬ ফেব্রুয়ারির ভোরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঠিক কী হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পুরো চিত্রটা পাওয়া যায়নি। সে যাই হোক, দুই দেশের সরকারি বিবৃতি থেকে এবং প্রাথমিক প্রতিবেদনগুলি থেকে কয়েকটি অংশ বেছে নিয়ে আন্দাজ করা যাচ্ছিল যে পরবর্তী প্রথম ২৪ ঘণ্টায় কী হতে চলেছে।
রাতের অন্ধকার কেটে যাওয়ার আগেই ভারতীয় বায়ুযেনার বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে – পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়ার বালাকোট, যেখানে একটি জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির ছিল, সেখানে আক্রমণ করে। আমরা কেবলমাত্র আন্দাজই করে যেতে পারি, শুধুমাত্র এখন নয়, হয়তো কোনও দিনই আমরা জানতে পারব না যে সেখানে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং হতাহতের সংখ্যা ঠিক কত। পাকিস্তান মেনে নিয়েছে যে ভারতের বায়ুসেনা সেখানে প্রবেশ করেছিল এবং তারা সেখানে ‘ভারী কিছু’ নিক্ষেপ করেছে, তবে বস্তুতপক্ষে কোনও ক্ষয়ক্ষতিই হয়নি।
নিঃশব্দে হলেও কার্যকরী: বালাকোটে জৈশ-ই-মহম্মদের শিবিরে ভারতীয় বায়ুসেনার বিমান থেকে ভারী কিছু নিক্ষেপ করার ফলে ধ্বংসাবশেষ। (টুইটার/@OfficialDGISPR)
অ্যাবোটাবাদে যে মার্কিন হানাদারিতে ওসামা বিন লাদনকে হত্যা করা হয়েছিল এবং ২০১৬ সালে ভারতীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিল সেই সব ঘটনা প্রাথমিক ভাবে অস্বীকার করার উদাহরণ থাকলেও এগুলোকে না হয় ধরে নেওয়া হল যে মুখ বাঁচাতে পাকিস্তান সে সব কথা বলেছিল এবং সে কথা মনে করে এ নিয়ে কিছুটা সংশয়ের মাত্রা রেখেও দেওয়া হল।
এই আক্রমণ কেন তাৎপর্যপূর্ণ?
প্রথমত, পারস্পরিক বিবাদের মীমাংসা করার জন্য নতুন করে নিয়মাবলি লেখার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে ভারত।
পাকিস্তানের বেঁধে দেওয়া বাধ্যবাধকতা বা সীমাবদ্ধতায় বহু বছর ধরেই আটকা পড়েছিল নতুন দিল্লি। এর মধ্যে ছিল পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের বাইরে কোন রকম প্রতিশোধ বা প্রত্যাঘাত করা যাবে না, যদিও পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা তাদের হামলার লক্ষ্যে পঞ্জাব-মুম্বই-দিল্লি কেন, ভারতের যে কোনও অংশই ছিল।
আর একটা দিক হল, ১৯৮০-র দশক এবং ২০০০-এর প্রথম দশকেও ভারতর গতে বাঁধা সিদ্ধান্ত ছিল যে কোনও ভাবেই বিমান-হামলা করা যাবে না। এর কারণ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এই ধরনের হামলা করলে উভয পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে, বহু ভারতীয়ের জীবনহানি ও এ দেশের বহু সম্পত্তিহানি ঘটবে এমনকি তা শেষ পর্যন্ত পরমাণু যুদ্ধের দিকেও গড়াতে পারে। এই সব আশঙ্কা সত্যি কিনা তার পরীক্ষা হয়ে যাবে এই বিমান হামলার ফলে।
দ্বিতীয়ত, বিদেশসচিব বিজয় গোখেল ভারতের হয়ে যে সরকারি বিবৃতি দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে যে এই বিমানহামলা ছিল হামলার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য (pre-emptive), এবং তা করা হয়েছিল জৈশ-ই-মহম্মদ ভবিষ্যতে হামলার যে ছক কষছে তা নিয়ে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে। আসন্ন ও অনিবার্য এই হামলা থেকে আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু দরকার (proportional) শুধুমাত্র সেইটুকুই (limited) করা হয়েছে এবং এমন ভাবে করা হয়েছে যাতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা যৎসামান্য হয়, যেমন সাধারণ মানুষের জীবনহানি। ভারতের এই ন্যায্য যুক্তি একই সঙ্গে দুটি উদ্দেশ্য সাধন করেছে – প্রথমত আন্তজার্তিক মহলে ভারতের অবস্থান খুব দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং দ্বিতীয়ত সম্ভাব্য পাকিস্তানি প্রতি-আক্রমণের আশঙ্কাকে প্রশমিত করে দেওয়া।
#WATCH Foreign Secy says,"This facility in Balakot was headed by Maulana Yusuf Azhar alias Ustad Ghauri, brother in law of JeM Chief Masood Azhar...The selection of the target was also conditioned by our desire to avoid civilian casualty. It's located in deep forest on a hilltop" pic.twitter.com/QENnnkU5Rh
— ANI (@ANI) 26 February 2019
তৃতীয়ত, লক্ষ্যবস্তুটিও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ – বালাকোটে জৈশ-ই-মহম্মদের প্রশিক্ষণশিবির।
১৯৯৯ সালে ভারতের হেফজত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ২০০০-২০০১ সালে তৈরি জৈশ-ই-মহম্মদের প্রথমদিককার প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।
একেবারে প্রথম দিকে এই প্রশিক্ষণ শিবিরটি ছিল পাকিস্তান ও পাকিস্তানের বাইরে অন্য কোনও দেশে কোনও লক্ষ্যে আঘাত হানার ব্যাপারে পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া ও আত্মঘাতী হামলার প্রশিক্ষণ শিবির। এর মধ্যে ছিল, পাকিস্তানে যারা ধর্মীয় ভাবে সংখ্যালঘু তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি কার্যকলাপ করা, আফগানিস্তানে মার্কিনিরা এবং নিয়ন্ত্রণরেখা বরবর উদ্বাস্তুরা। ২০০৫ সালে কাশ্মীরে তীব্র ভূমিকম্পে এই শিবির ব্যাপক ভাবে ক্রতিগ্রস্ত হয় এবং তারপরে আবার তা নতুন করে তৈরিও করা হয়।
তারপর বছরের পর বছর ধরে এই জায়গাটা হয়ে উঠেছিল মৌলানা মাসুদ আজহার ও তার শাগরেদদের নিয়মিত ভাবে বক্তৃতা করার জায়গা। বিজয় গোখেল বলেছেন যে এই ক্যাম্পটি চালাত মাসুদ আজহারের ভাতৃস্থানীয় আত্মীয় ইউসুফ আজহার। পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে গত কয়েক বছর ধরেই এখানে জৈশ-ই-মহম্মদের কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ছিল।
অতীতে নিয়মিত ভাবে এই শিবিরে দেখা যেত সন্ত্রাসবাদী মাসুদ আজহারকে। (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
২০১৪ সালে নিয়োগ বাড়ানোর ফলে জৈশ-ই-মহম্মদের পুনর্গঠন হয় – একই সঙ্গে লস্কর-ই-তৈবা নিয়ে তাদের সীমাবদ্ধতাও কমে যায়। বালাকোটে যে প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে সেখানে প্রশিক্ষণের কী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তার আকার-আকৃতি কেমন, সেখানে কী ধরনের কাজকর্ম হয় এবং প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ করে কত জন এখন জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে রয়েছে সে ব্যাপারে সম্ভবত শুধু ভারতের কাছেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব-সহ বিভিন্ন দেশের কাছেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত গোয়েন্দাতথ্য রয়েছে।
তবে এমন বহু প্রশ্ন রয়েছে যে সবের উত্তর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি – আর এমন অনেক প্রশ্ন আছে যে সবের উত্তর কোনও দিনও পাওয়া যাবে না। যা ঘটেছে পাল্টা কী হবে সেটা আন্দাজ করা অসম্ভব, এটা নির্ভর করছে এই আক্রমণের অভিঘাতকে পাকিস্তান ঠিক কী ভাবে দেখছে।
যখন অ্যাবোটাবাদের হামলায় ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছিল তখন জনগণের চাপে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই অবস্থান বদলে ফেলেছিল পাকিস্তান। কী ভাবে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে বিশ্রী ভাবে উপেক্ষা করে সেখানে মার্কিন সেনা প্রবেশ করল সেই প্রশ্ন থেকে সরে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা দাবি করতে শুরু করে দেয় যে তাদের জানিয়েই সবকিছু হয়েছে (যদিও নিজেদের সুবিধার জন্যই লাদেনের শেষ পর্যন্ত কী হল, সেই প্রশ্নের জবাব তারা এড়িয়ে গিয়েছে)।
আমরা ঠিক সেই রকম লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি, যা ক্রমেই পাকিস্তানি সেনার উপরে চাপ বাড়াতে থাকবে।
উল্টোদিকে, আমরা দেখতে পাচ্ছি শেষ মুহূর্তে তারা স্টেজে মেক-আপ দেওয়ার মতো দেখাতে চেয়েছে যে পুলওয়ামায় যা হয়েছে সেই তুলনায় ভারত কিছুই করতে পারেনি, এখন পাকিস্তান জবাব চাইবে, আর আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চোখে ব্যাপারটা ক্রমেই ভারতের পক্ষেই যেতে থাকবে যে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হল পাকিস্তান।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে