পিছিয়ে গেল অযোধ্যা মামলা: লোকসভা নির্বাচনের আগে এটা কেন বিজেপির কাছে সুখবর
সমাধান খোঁজার বদলে যারা বিরোধিতা করছে তারা সর্বোচ্চ আদালতের বিচার বিলম্বিত করছে
- Total Shares
বহু প্রতীক্ষিত রাম জন্মভূমি বাবরি মসজিদ বিতর্ক নিয়ে ৩০ অক্টোবর যে শুনানি হওয়ার কথা ছিল তা জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট।
কেন যে ধর্মাবতার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না বা সমালোচনাও করতে পারবে না। তবে অনেকেই হয়তো স্মরণ করতে পারবেন যে এ ব্যাপারে আবেদন করার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন বরিষ্ঠ কৌঁসুলি – কপিল সিবাল, রাজীব ধাওয়ান ও দুষ্যন্ত দাভে – তাঁরা বলেছিলেন যে এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরেই এ ব্যাপারে শুনানি হোক।
ভোটের মরসুমে এই বিলম্বের কী ফল রাজনৈতিক ভাবে ফলবে তা আগাম আঁচ করা খুবই কঠিন বিজেপি, আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কয়েকজন নেতা ইতিমধ্যেই সরকারের কাছে দাবি করেছে তারা যেন অধ্যাদেশ জারি করে বা আইন করে রামন্দির নির্মাণ শুরু করে দেয়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা: অযোধ্যা নিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষা করা নিয়ে কারও কোনও ইচ্ছা নেই (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
তবে সেই কাজ করলে তা বেশ ঝুঁকির কাজই হয়ে যাবে। উল্টো দিকে, যদি কোনও কারণে সেই অপ্রিয় সিদ্ধান্ত সরকার নিতে না চায় তা হলে সরকারের পক্ষে তার সমর্থকদের মন পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে।
যখন সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে কোনও রকম বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ এবং এক দমবন্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখন সাময়িক ভাবে সেই পরিস্থিতিতে ছেদ পড়বে এ কথা ভাবা বেশ কষ্টকর। রাজ্যগুলির তো বটেই, লোকসভা ভোটের প্রস্তুতিতেই বা কী হবে সে কথা আগে থেকে বলা যাবে না। মিটমাটের ব্যাপারটা দীর্ঘায়িত করায় সম্ভবত কারোরই স্বার্থ নেই।
প্রত্যেকেই বুঝতে পারছেন যে ১৯৯২ সালের পর থেকে জীবনটা বদলে গেছে। ভারতের বর্মান জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশেরই বয়স ২৭ বছরের কম। মানে তাঁদের জন্মই হয়েছে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের পরে, যে দিন করসেবকরা বাবরি মসজিদের সেই ঘেরাটোপ টপকে যান। তাঁদের অনেকেই ছিলেন আসন্ন নির্বাচনের প্রথম বারের কিংবা দ্বিতীয় বারের নির্বাচক।
কুড়ি বছরের কম বয়সী, যে প্রথম ওই গম্বুজে উঠেছিল তাঁর বয়স এখন হবে চল্লিশের কোঠায়। যাঁরা ১৯৮০-র দশকে সেই রামমন্দির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এখন তাঁরা ষাটের কোঠায়।
তা সত্ত্বেও অযোধ্যা এখনও হাতিয়ার হিসাবে রয়ে গিয়েছে। তা সম্ভব হয়েছে, কারণ অযোধ্যা ও রামমন্দির হল একটা প্রতীকমাত্র। এর গভীরে আরেকটি ইস্যু রয়েছে, মনেপ্রাণে হিন্দু পরিচয়ে বিশ্বাস।
“হিন্দু ভূখণ্ড”-এর বাস্তবায়নই রামভক্তদের কাছে পরম পূজ্য বিষয়। ১৯৯২ সালের সেই ঘটনা অযোধ্যায় রামমন্দির ইস্যুতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে।
লক্ষ্যভ্রষ্ট: নিষ্পত্তি পিছিয়ে যাওয়ার ফল কী হতে পারে সেই ভবিষ্যদ্বানী করা খুবই দুরূহ (সৌজন্য: ইন্ডিয়াটুডে.ইন)
বাঙালি হিসাবে বেড়ে ওঠায়, পূর্ব ভারতের অন্যদের মতো আমার কাছেও রাম ছিল একটি পৌরাণিক চরিত্র। তিনি পবিত্র ছিলেন কিন্তু ঈশ্বর ছিলেন না। আমি সাহস করেই বলছি, খুব কম বাঙালিই রামায়ন পড়েছে। এদের মধ্যে যাঁরা রামচরিতমানসের নাম শুনেছেন তাঁরা মনে করতেন যে ওটা ‘হিন্দুস্তানি’দের ব্যাপার। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত বাঙালিদের কোনও মন্দিরেই হনুমানের পুজো হতে দেখা যেত না। তবে জনবিন্যাসে পরিবর্তন হতেই হনুমান চালিসাও ঢুকে পড়ে।
পূর্ব ভারত ও উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে পরিস্থিতি মোটের উপর এই রকমই ছিল। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণেরও অবস্থাটা এর চেয়ে খুব একটা আলাদা ছিল না। তাঁর সেই ঐতিহাসিক রথযাত্রা দিয়ে পুরো ভারতের ভাবনাচিন্তাই বদলে দিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী।
সারা ভারতেই দেখা গেল শ্রীরামচন্দ্রকে সকলেই গ্রহণ করছেন। হিন্দিভাষাভাষী বলয়েল মতো রামের প্রতি আবেগ না থাকলেও দেখা গেল যে রামকে সকলেই পছন্দ করতে শুরু করেছেন। ভারতের সংস্কৃতির ভাবধারা ও ধর্মনিপক্ষে ভাবের সঙ্গেও তিনি বেশ মানানসই হয়ে গেলেন। এটা ছিল অত্যন্ত নিপুণ এক রাজনৈতিক চাল।
ভারতের রাজনীতিতে রামমন্দির হল অনেকটা ছায়ার মতো। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ছিল সংহতি নষ্ট করা। পরবর্তী কালে এ নিয়ে প্রবল সমালোচনাও সহ্য করতে হয়েছে আডবাণীকে। তবে পরবর্তী বছরগুলিতে রাজনীতিতে আডবাণীর অবদান ছিল অতি নগণ্য।
বিপরীত একটি মতামতও অবশ্য থাকতে পারে। যদি রামমন্দির না থাকত তা হলে বিজেপিকে অন্য কোনও অ্যাজেন্ডার উপরে নির্ভর করেই তাদের সমর্থকদের নিয়ে যুদ্ধে নামত।
তাও এখনও অনেকেই মনে করেন যে ধর্মীয় মেরুকরণের জন্যই রামমন্দির নিয়ে উস্কানি দিচ্ছে বিজেপি। ১৯৮০-র সেই হিন্দুদের মধ্যে যে তথাকথিত নেতিবাচক ভাব দেখা গিয়েছিল সেটাকেই এখন গরিষ্ঠতামূলক ভাব বা মেজরিটারিয়ানিজম বলা হচ্ছে।
এ কথা ঠিক যে বিজেপি এবং আরএসএস – উভয়কেই এই বিষয়টিকে জ্বলন্ত ইস্যু হিসাবে জিইয়ে রাখতে হবে। তবে সত্যি কথা বলতে কী, বিজেপি কোনও দিনই এই বিষয়টিকে নির্বাচনী বৈতরণী হিসাবে ব্যবহার করেনি। ২০১৪ সালে তারা যে বিপুল ভাবে জয়ী হয়েছিল সেখানে তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল পরিবর্তন ও উন্নয়ন।
গন্তব্য অযোধ্যা: ১৯৯০ সালের রথযাত্রার মাধ্যমে সারা দেশের ভাবনাকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী (সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে)
কংগ্রেস মনে করে যে মন্দিরের তাসই হল বিজেপির একমাত্র অস্ত্র। যদি এই অস্ত্র ভোঁতা হয়ে যায় তা হলে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে, তা সে আজ হোক বা কাল, এই অস্ত্র বিজেপি প্রয়োগ করবেই। তাই তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল রক্ষণাত্মক।
বিজেপিকে শায়েস্তা করতে অন্য সংখ্যালঘুদের হাতিয়ার করল কংগ্রেস যেমন তারা প্রক্সি হিসাবে ব্যবহার করল অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোন্যাল ল বোর্ডকে। কংগ্রেস তাদের আইনি সহায়তা দিতে শুরু করল।
কোনও সমাধান খোঁজার বদলে তারা ক্রমাগত সুপ্রিম কোর্টের বিচারের পথ আটকানো শুরু করে দিল।
কেউ হয়তো এই যুক্তি খাড়া করতে পারেন যে এই দীর্ঘসূত্রতার রাজনীতি বিজেপির পক্ষেও ভালো হয়েছে। এর ফলে তাদের চূড়ান্ত পদক্ষেপ করতে হচ্ছে না। কঠোর সমালোচনা করলেও বিজেপিও কখনও চাইবে না বাঘের পিঠে চড়ে বসতে। বিজেপির শীর্ষস্থানীয়ী নেতারা যে বলছেন রামমন্দির কোনও দিনই নির্বাচনী ইস্যু হবে না, তা থেকেই এ কথা বোঝা যাচ্ছে।
জাতীয় শক্তি হিসাবে বিজেপিকে অবশ্য এ কথা বলতেই হবে। একজোট হওয়া বিরোধীরা চাইবে নরেন্দ্র মোদীর চেয়ে ভালো কাউকে। তবে তারা চাইছে না যে বিজেপি সরে যাক। কারণ তাদের একটি হিন্দু স্বত্ত্বা রয়ছে, যে সত্ত্বা অস্বীকার করলে তাদের খালি হাতেই ফিরতে হবে।
এতদিন ধরে হিন্দু ভোটারদের কোনও রকম গুরুত্ব না দিলেও কংগ্রেস এখন এ কথা বুঝতে শুরু করেছে। হিন্দুত্ব নিয়ে তাদের সম্ভাব্য পদক্ষেপ থেকেই সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কৌশলগত ভাবে বিজেপিও চাইবে পরিস্থিতি গরম রাখতে। তবে নরেন্দ্র মোদী এবং তার ঠিক পরের সারির নেতা যেমন অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, নীতিন গড়করিরা চাইবেন না এ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে।
তাঁরা দ্রুত কোনও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিয়ে মন্দির নামক সেই বোতামটিতে চাপ দিয়ে তাঁদের সমর্থকরে এমন কোনও বার্তা দেবেন না যাতে বিষয়টি হাত থেকে বেরিয়ে যায় এবং সমর্থকরা ভেবে নেন যে এটি সুদূরপরাহত।
বিজেপি নেতারা তাদের রাজনৈতিক জ্ঞানের সবটুকু প্রয়োগ করে তাদের সমর্থকদের এ কথা বিশ্বাস করাবেন যে রামমন্দির হল বিশ্বাসের প্রতীক। সেই মন্দির যুগ যুগ ধরে তাঁদের হৃদয় ও চেতনার আধারে বিরাজমান। নির্মাণ হলে সেই প্রতীক শুধুমাত্র একটি পার্থিব রূপ পাবে। বরং তারা যদি আরও একবার পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে তা হলেই তারা এই কাজ করবে।
তা হলেই বিজেপি এ থেকে ভোটে ময়দানে সুবিধা করে নিতে পারবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে