অটলবিহারী বাজপেয়ী: সত্যিকারের গণতন্ত্রবাদী, কঠোর সমালোচক ও রাজনৈতিক বিরোধীদের বন্ধু
বাজপেয়ীর প্রতি সোনিয়ার শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল... রাহুল বহুবার আফশোস করেছেন
- Total Shares
নানাবিধ কারণের জন্যই অটলবিহারী বাজপেয়ী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত এমন একজন প্রধামনমন্ত্রী তিনি ছিলেন যিনি তাঁর বিরোধীদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতেন যাঁর মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরু থেকে সনিয়া গান্ধীও।
যদিও ১৯৬২ সালে চিন যুদ্ধের সময় তৎকালীন তথা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যখন সংসদের বিশেষ অধিবেশেন ডেকেছিলেন, তখন তিনি তাঁর সমালোচনা করেছিলেন এবং সেই সমালোচনা আকৃষ্ট করেছিল নেহরুকেও। রক্ষণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করা জওহরলাল নেহরু সেদিন তাঁর যুক্তি মেনেছিলেন এবং তার উপরে বিতর্কের জবাবও দিয়েছিলেন। যে যাই হোক, দেশে হোক বা বিদেশে, বাজপেয়ী কোনও দিনই নেহরুর প্রশংসা করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি।
তরুণ সমালোচক থেকে বিচক্ষণ নেতা: অটলবিহারী বাজপেয়ী (সৌজন্য: Twitter/@IndiaHistorypic)
ঘটনা হল, ১৯৭৭ সালে বাজপেয়ী যখন মোরারজি দেশাই মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পান, তখন তিনি বিদেশমন্ত্রীর আসনের পিছনের দেওয়ালে থাকা নেহরুর ছবিটি আগের মতোই রেখে দেওয়ার নির্দেশ দেন। কেন্দ্রে প্রথম বার অকংগ্রেসি সরকার গঠিত হওয়ার পরে অতিরিক্ত হিংসাপরায়ণ বাবুরা সেই ছবিটি সরিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ গঠিত হল, পাকিস্তানকে পরাজিত করার জন্য তখন ইন্দিরা গান্ধীকে “অভিনব চণ্ডী দুর্গা” বলে অভিহিত করেছিলেন বাজপেয়ী। বাজপেয়ীর সেই মন্তব্য কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অতিমানবীয় এক রূপ পেতে সাহায্য করেছিল। ইন্দিরাও তাঁর বন্ধু ও জীবনীকার পুপুল জয়কারকে বলেছিলেন যে, “যুদ্ধের সময় এমনকি তার আগেও অলৌকিক শক্তি ও অদ্ভুত অভিজ্ঞতা” তাঁর হয়েছিল।
১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর, অটলবিহারী বাজপেয়ী ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও (ছবি: পিটিআই)
ইন্দিরা গান্ধীকে দেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করা নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল।
প্রেমকুমার মণি নামে এক দলিত নেতা স্মৃতি ঘঁটে বললেন “কিসি কি পূজা কর রহে হ্যায় বহুজন” (কারা নীচুজাতের পুজো করছে) শিরোনামে একটি প্রবন্ধে কমিউনিস্ট নেতা এসএ ডাঙ্গে কী ভাবে বাজপেয়ীর সেই কথার বিরোধিতা করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে বাজপেয়ীর দুর্গার সঙ্গে তুলনার প্রেক্ষিতে তিনি নাকি বলেছিলেন, অটল বিহারী জানেন না যে তিনি কি বলছেনআর ইন্দিরা গান্ধী তো বুঝতেই পারবেন না যে তিনি কী শুনছেন। দুজনেরই জানা উচিত যে দলিত ও পিছিয়েপড়াদের ধ্বংস করেছিলেন চণ্ডী দুর্গা।”
পিভি নরসিমহা রাওয়ের মৃত্যুর তিন দিন পরে ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাজপেয়ী বলেছিলেন, ভারতের পরমাণু প্রকল্পের ‘প্রকৃত জনক’ হলেন নরসিমহা রাও। সেই দিন তাঁর নিজের শহর গোয়ালিয়রে লেখকদের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে বাজপেয়ী বলেছিলেন যে ১৯৯৬ সালে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন (১৩ দিনের জন্য) তখন তাঁর পূর্বসূরীর থেকে একটি কাগজ পান যেখানে দেশের পরমাণু গবেষণা এগিয়ে যাওয়ার অনুরোধ তাঁকে করা হয়েছিল।
নিজের অননুকরণীয় ঢঙে বাজপেয়ী সে দিন বলেছিলেন, “রাও আমাকে বলেছিলেন যাতে কথাটা পাঁচকান না হয়। আজ যখন তিনি নেই এবং আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আমি চাই সোজাসুজি ভাবে তাঁর কৃতিত্বটা জানিয়ে দিতে। রাও আমাকে বলেছিলেন যে বোমা প্রস্তুত। আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলাম সেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে।”
বাজপেয়ী বলতেন তিনি কখনও নিজে থেকে কংগ্রেসকে দোষারোপ করতেন না। তিনি বলতেন “পাকিস্তান ও চিনের মোকাবিলা করার জন্য ওঁরাও শক্তিশালী ভারত গড়তে চাইতেন। বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ওঁরা কখনও প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হননি।” বছর দশেক পর থেকেই অবশ্য দেশের যা কিছু মন্দ সে সব কিছুর জন্য সেই ক্রমাগত কংগ্রেসকেই দোষারোপ করেন তাঁর দলের নেতারা।
কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি বাজপেয়ীর শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণ রয়েছে। ১৯৯৪ সালে জম্মু-কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে পাকিস্তান যখন সেটিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বড়সড় ইস্যু করছে তখন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও জেনেভায় হিউম্যান রাইটস কমিশনে ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে বাজপেয়ীকে পাঠিয়েছিলেন। জেনেভা থেকে বিজয়ী হয়ে ফেরা তখন আলিঙ্গন করছেন বিদেশপ্রতিমন্ত্রী সলমন খুরশিদকে, ইন্ডিয়া টুডের প্রচ্ছদের সেই ছবি এখনও অনেকের স্মৃতিতে ধরা রয়েছে।
ভারতের পক্ষে: ১৯৯৪ সালে সলমন খুরশিদের সঙ্গে বাজপেয়ী (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
বফর্স, শাহ বানু, অযোধ্যা বিতর্ক প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে অটলবিহারী বাজপেয়ীর তিক্ত রাজনৈতিক লড়াই হয়েছে। ১৯৯১ সালের মে মাসে শ্রীপেরুমবুদুরে যখন বোমা বিস্ফোরণে রাজীব গান্ধী নিহত হলেন তখন নামী সাক্ষাৎকারগ্রহীতা করণ থাপারকে ডেকেছিলেন বাজপেয়ী। তাঁকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন (১৯৮৪-১৯৮৯) রাজীব গান্ধী জানতে পারেন যে কিডনির জটিল সমস্যায় ভুগছেন বাজপেয়ী এবং বিদেশে তাঁর বিশেষ ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন। থাপারকে বাজপেয়ী সেদিন বলেছিলেন, রাজীব তাঁকে ফোন করেন এবং বলেন যে তিনি তাঁকে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভারতীয় প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। থাপারকে সেই টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বাজপেয়ী বলেন যে, “তিনি (রাজীব) চেয়েছিলেন আমি যেন চিকিৎসার প্রয়োজনে এই সুযোগ কাজে লাগাই। আমি নিউ ইয়র্কে যাই। সেই জন্যই আমি এখনও জীবিত রয়েছি।”
অন্য একটি ঘটনায় ২০০২ সালে নিউ ইয়র্কে তিনি সনিয়া গান্ধীর নাম করেছিলেন। ২০০১ সালে সংসদে হামলার পরেই সোনিয়া গান্ধী ফোন করে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীকে বলেন, “আপনি কোথায়, ঠিক আছেন তো? আমি ঠিক আছি, আপনি ঠিক আছেন তো?”
সনিয়া গান্ধী তখন ছিলেন বিরোধী দলনেত্রী।
উপস্থিত দর্শকদের বাজপেয়ী বলেছিলেন, “এটাই হল গণতন্ত্রের মহত্ব। রাজনৈতিক ভাবে আমাদের মতপার্থক্য রয়েছে কিন্তু সারা দুনিয়া বিশ্বাস করে যে ভারত ঐক্যবদ্ধ ভাবে আগুয়ান হচ্ছে।”
পারস্পরিক সম্মান: বাজপেয়ী ও সনিয়া গান্ধী, রাজনৈতিক উত্থানের জন্য বাজপেয়ীর কাছে যিনি ঋণী (ছবি: এপি)
সনিয়ার বিচক্ষণ রাজনীতিক হিসাবে গড়ে ওঠার পিছনে অনেক ক্ষেত্রেই বাজপেয়ীর অবদান রয়েছে। (এ কথা আমি সোনিয়া এ বায়োগ্রাফি; পেঙ্গুইন ২০০৩, পৃষ্ঠা ৯৪-৯৫ বইয়ে উল্লেখ করেছি)। ২০০১ সালে জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দলের নেত্রী হিসাবে সোনিয়াকে প্রেরণ করেন বাজপেয়ী, যার ফলে সোনিয়া তাঁর সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হন।
তখন বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন সোনিয়া গান্ধী। রাষ্ট্রপুঞ্জের এইডস কনফারেন্সের দায়িত্ব দেওয়ায় সোনিয়ার যে উত্তরণ ঘটেছিল তাতে বিজেপি-এনডিএ-র অনেকের মন ভেঙে গিয়েছিল। শোনা যায় সেই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার আশা ভঙ্গ হওয়ায় বাজপেয়ী সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিপি ঠাকুরের নাকি গোঁসা হয়েছিল।
সনিয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ আসে যখন তিনি মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি ডিক চেনির সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। একের পর এক আলোচনা, সাংবাদিক বৈঠক... সর্বত্রই বিজেপির সঙ্গে তাঁর মতবাদ ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ এড়িয়ে চলেছিলেন সোনিয়া গান্ধী। তিনি জোর দিয়েছিলেন দারিদ্র্য দূরীকরণ, রোগ নিরাময় ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো জাতীয় সমস্যাগুলোয় মতানৈক্যের উপরে।
বাজপেয়ীর প্রতি সোনিয়ার শ্রদ্ধা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল – প্রিয়াঙ্কা ও রাহুলেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর প্রতি অপার শ্রদ্ধা ছিল। ব্যক্তিগত আলোচনায় রাহুল আক্ষেপ করেছেন যে তিনি বেশি কথা বলার সুযোগ না পাওয়ায় অটলবিহারী বাজপেয়ীর থেকে তেমন কিছু শেখার সুযোগ পাননি।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে