অটলবিহারী বাজপেয়ী কেন প্রকৃত অর্থেই একজন উদার অর্থনীতিক
বাজপেয়ীই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি সরকারি খরচে লাগাম দেন
- Total Shares
অটলবিহারী বাজপেয়ীকে লোকে কী ভাবে মনে রাখবে? একজন উদারপন্থী নেতা নাকি অর্থনৈতিক উদারপন্থী? জোট সরকার পরিচালনা করার জন্য তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে উদারপন্থী হতেই হত, তবে সত্যি কথা বলতে কী, তিনি প্রকৃত অর্থেই অর্থনৈতিক উদারপন্থী ছিলেন। ক্ষমতা নিয়ে সামান্য লড়াইয়ের বাইরেও বাম, ডান ও মধ্যপন্ধীদের সমালোচনার মধ্যেও তিনি উদার অর্থনৈতিক নীতির প্রবর্তন করে তিনি একটি যুগের সূচনা করতে পারতেন।
তিনটি পৃথক মেয়াদে তিনি মোটামুটি বছর ছয়েক ক্ষমতায় ছিলেন, জোট শরিকদের সামলে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, যুদ্ধ, খরা ও সন্ত্রাসের মধ্যেও তিনিই ভারতকে বিশ্বের দ্রুততম উন্নয়নসীল দেশে পরিণত করেছিলেন।
সম্ভবত সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে তিনি অর্থনৈতিক উত্তরণে সফল হয়েছিলেন সম্ভবত তাঁর উদার বাজার অর্থনীতির জন্য। জোট শরিকদের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েও ১৯৯১ সাল পরবর্তী সময়ে অথর্নীতির বিচারে তিনি সবচেয়ে খোলামেলা ও উদারপন্থী সরকার পরিচালনা করেছিলেন।
নির্বাচনী বাধ্যবাধকতার মধ্যেই ১৯৯১ সালের পর থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ীই অর্থনীতির বিচারে সবচেয়ে খোলামেলা ও উদারপন্থী সরকার উপহার দিয়েছিলেন (সৌজন্য – ইন্ডিয়া টুডে)
তাঁর নীতির জেরেই পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, লাহোর বাসযাত্রা, কার্গিল যুদ্ধ, কান্দাহারে বিমান অপহরণ, খরা ও সংসদ ভবনে হামলার জেরে তৈরি হওয়া প্রতিকূল পরিস্থিতি ও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেও তাঁর সময়েই ভারত অভূতপূর্ব বিকাশের হার স্পর্শ করে।
পোখরান ২ হল বিশ্বের তাবড় এলিট নিউক্লিয়ার ক্লাব-এর মধ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে এক সাহসী পদক্ষেপ। তবে পোখরান পরবর্তী পরিস্থিতি বাজপেয়ী কী ভাবে সামলেছিলেন তা অকথিতই রয়ে গেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নেতৃত্বে বিশ্ববাণিজ্যের নতুন যুগ শুরু হচ্ছে, দু-বার জোট সরকারের পতন ঘটেছে, অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ভারতের অর্থনীতি যখন আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঊর্ধ্বগামী ঠিক তখনই ঘটল পোখরান। বিশ্বায়নের পাখায় ভর করে অর্থনীতি যখন দূর আকাশে পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, ঠিক তখনই ঘটল পোখরান, যা নরেন্দ্র মোদী নোটবাতিলের চেয়ে অনেক বড় ব্যাঘাত। পোখরানের পরেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আর বাজপেয়ী সেই পরিস্থিতি সামলে দিলেন উদীয়মান ভারতের অঙ্গীকার (রিসার্জেন্ট ইন্ডিয়া বন্ড) দিয়ে। পাঁচ বছরের সেই সময়কালে সুদের হার চড়া করে দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ৮,৭০০ কোটি টাকার বেশি তুলে ফেলা সম্ভব হয়েছিল এবং ভারতে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ও যথেষ্ট ভালো করে ফেলা হয়েছিল।
পোখরানের পরে বাজপেয়ী যখন আবার ক্ষমতায় এলেন তখন তিনি দেশের বাজারের প্রতি চরম উদারপন্থী মনোভাব দেখিয়ে আমদানিশুল্ক হ্রাস করে দিলেন, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নীতি উদার করে দিলেন এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের জোর দিলেন। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের স্বর্গ হয়ে উঠেছিল ভারত।
বিশ্বে সম্ভবত এটাই একমাত্র উদাহরণ যেখানে একটি দেশের ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যবর্তী সময়ে একটি দেশ শুধুমাত্র বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে বিকাশ ঘটাতে পেরেছিল।
অটলবিহারী বাজপেয়ী হলেন প্রধানমন্ত্রী যিনি সরকারি খরচে লাগাম পরিয়েছিলেন (ইন্ডিয়া টুডে)
বাজপেয়ীর অর্থনৈতিক উদারীকরণের মূলে ছিল কাঠামোগত পরিবর্তন। দেশের বাজার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে খুলে দেওয়া ছিল ন্যূনতম শাসনের উপরে প্রতিষ্ঠিত সুচিন্তিত পদক্ষেপ। বাম ও দক্ষিণপন্থীদেদর আগ্রাসী ও চরম বিরোধিতার মাঝে, জোট সরকারের বাধ্যবাধকতার মধ্যেও অভূতপূর্ব ভাবে বাণিজ্য স্থাপনার মধ্য থেকে সরকারি হস্তক্ষেপ দূর করেন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের দিকে পদক্ষেপ করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কৌশলগত বিক্রয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সরকারের একচেটিয়া অধিকারে দাঁড়ি টানার ফলে এই সব ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক নিয়ামক তৈরি হল। যেমন বিমা ও পেনশন ক্ষেত্রে আইআরডিএ এবং পিএফআরডিএ, কম্পিটিশন কমিশন প্রভৃতি। টেলিকম ক্ষেত্রের নিয়ামক সংস্থা ট্রাই এবং বিমান ক্ষেত্রে এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া আরও বেসি করে ক্ষমতার অধিকারী হয়।
বাজপেয়ীই ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি সরকারি খরচে লাগাম পরান। তাঁর সরকারই প্রথম অর্থনৈতিক দায়িত্ব ও বাজেট ব্যবস্থাপনা (এফআরবিএম) আইন চালু করে যার লক্ষ্য ছিল সরকারের বাজেটঘাটতি নির্দিষ্ট করা, তাও তিনি এটা করেছিলেন এমন এক সময়ে যখন এই ধরনের বাবনা উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো পক্ষেও ভাবা সম্ভব ছিল না।
অর্থনৈতিক সংস্কারের অঙ্গ হিসাবে সারা দেশে অভিন্ন কর ব্যবস্থা (জিএসটি) প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল বাজপেয়ী সরকারের আমলেই। বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েই ২০০২ সালে বিজয় কেলকারের নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রথম পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) প্রস্তাব করে যেখানে ১২ শতাংশ হারে কর ধার্য করার কথা সুপারিশ করা হয়। এফআরবিএম আইনের সৌজন্যে এখন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের ব্যাপারে ভারত বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে।
বাজপেয়ীর অর্থনাতিক বিচক্ষণতার জন্যই ভারত তাঁর সময়ে বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায় না মনমোহন সিংয়ের ১০ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়, না নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে ভারত এই ধরনের বিকাশে সমর্থ হয়েছে।
অর্থনৈতিক বিচারে, আমরা এখনও বাজপেয়ী-যুগেই রয়েছি, কারণ এখন যা ঘটছে তা তাঁর ইতিবাচক কাঠামোগত সংস্কারের জন্যই ঘটছে। বাজপেয়ী-যুগকে তাই রাজনৈতিক উদারচেতা মনোভাব দিয়ে নয়, সংজ্ঞায়িত করতে হবে অর্থনাতিক স্বাধীনতার বিচারে। সেই সময়ের শরিকি রাজনীতির পরিস্থিতি বাজপেয়ীকে রাজনৈতিক ঔদার্যের পথে পরিচালিত করেছিল, তিন্তু বাম ও দক্ষিণপন্থীদের চরম অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে গিয়ে আর্থিক উদারীকরণ ছিল তাঁর একান্ত পছন্দ।
বাজপেয়ী একটি যুগের নির্মাণ করেছেন, তবুও তাঁকে স্মরণ করা হবে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দ্রুততম দেশনির্মাতা হিসাবে। সাইমন সিনেকের কথাকে যথার্থ করেছেন বাজপেয়ী, “নেতৃত্ব পরের নির্বাচনের জন্য নয়, পরের প্রজন্মের জন্য।”