পাকিস্তান ব্যতিরেকে এশিয়া: সৌদি অপরাধ ও ইরানের রহস্যময়তা
নিকট প্রতিবেশীর বাইরেও আরও দেশ আছে, তাদেরও আন্তর্জাতিক সমস্যা আছে
- Total Shares
আমরা যখন অন্য কোনও কোনও একটি দেশকে বলছি যাতে আমাদের প্রতিবেশী দেশটি ভারতে সন্ত্রাসবাদে মদত না দেয় সে ব্যাপারে তাকে বলতে, তখন ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধেই অভিযোগ রয়েছে যে তিনি তাঁর দেশের সীমান্তের বাইরে একটি জঘন্য হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ঠিকই ধরেছেন, আমি সৌদি আরবের যুবরাজ তথা আমাদের সম্মানীয় অতিথি মহম্মদ-বিন-সলমনের কথাই বলছি, খবর অনুযায়ী এবং মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী গত বছর ২ অক্টোবর তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট-এর কলামনিস্ট এবং সৌদি আরবের বিখ্যাত সাংবাদিক জামাল খাসোগ্গিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এক সময় রাজতন্ত্রের সমর্থক হলেও পরে নিজের দেশের ভয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা শুরু করেন জামাল খাসোগ্গি। তিনি যাতে পুনরায় বিবাহ করতে পারেন সে জন্য ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসে বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত কয়েকটি নথির কাজ সম্পূর্ণ করতে যান। তারপর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার খবর নিয়ে লোকজন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন তখনই যখন তুরস্কের কর্তৃপক্ষ দাবি করেন যে রিয়াধ থেকে আকাশ পথে এসে সৌদি আরবের গুপ্ত ঘাতকরা তাঁকে হত্যা করেছে এবং চেন-শ দিয়ে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে দেওয়া হয়েছে।
সারা বিশ্বকে আবার পরিতাপের সঙ্গেই বিশ্বাস করতে হল সৌদি আরবের সেই তত্ত্ব – সমাজের কল্যাণের জন্য তারা যা অকল্যাণকর মনে করে তা সরিয়ে দেয়, সে বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক না কেন। এ কাজ তারা করতে পারে তাদের হাতে পেট্রল থাকায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক থাকায়। শোনা যাচ্ছে যে, সৌদি আরবের যুবরাজের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশ্রী ভাবে পরিত্যাগ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যদি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে গুরুতর কোনও পদক্ষেপই তিনি করেননি।
জামাল খাসোগ্গির হত্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ককে তিক্ত করেছে। (ছবি: রয়টার্স)
ইতিমধ্যেই যুবরাজ (পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যম যাকে এমবিএস বলে উল্লেখ করে থাকে) তাঁর এশিয়া সফর শুরু করেছেন তাঁর ‘হৃত সম্মান’ পুনরুদ্ধারের জন্য, সংবাদমাধ্যমে কথা বলার জন্য এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পর্ক নতুন করে স্থাপন করার জন্য। তিনি পাকিস্তান হয়ে ভারতে এসেছেন এবং এর পরে তিনি চিনে যাবেন। প্রভাবশালী আলজাজিরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে যে আমেরিকার দয়ায় যে তাঁরা বেঁচে নেই সেটা দেখাতেই এখন তিনি কয়েকটা দেশ ভ্রমণ করছেন। যে পেট্রোলিয়ামের উপরে ভর করে তারা ভেসে আছে তার বাইরে তারা ডলার খরচ করে ইসলামের সেই অংশের জন্য যারা বিশ্ব জুড়ে অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
যে দেশটিকে সৌদি আরব সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে সেই দেশটি হল ইরান – স্বধর্মে তার একমাত্র বিরোধী।চল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানে যে বিপ্লব ঘটেছিল সেটা ছিল গত শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। তার এক দশক পরে ইরান সারা বিশ্বকে চমৎকৃত করেছিল কারণ অর্থনৈতিক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও এবং আমেরিকার প্রবল ঘৃণা সত্ত্বেও (যে দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন এবং তাঁর পূর্বসূরী যে পরমাণু চুক্তি সই করেছিলেন তা অস্বীকার করছেন) তখন তারা সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছিল।
পুরো অঞ্চলে সম্পদশালী সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইরান শুধু টিঁকেই নেই – একই সঙ্গে তারা অশান্ত পশ্চিম এশিয়ার ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী দেশ ইজরায়েলকে যারা মান্যতা না দেওয়ার ব্যাপারে সরব, তাদেরও সমর্থন করে।
ইরান হল সেই দেশ যাকে ভীষণ অপছন্দ করে সৌদি আরব। (ছবি: রযটার্স)
সেই কারণেই ইরান বিপ্লবের ৪০ তম বর্ষ উপলক্ষে সারা বিশ্বের সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল। কিন্তু যখন ইরানের দিকে তাকাবেন তখন দেখবেন যে ইরানের বিপ্লবের পরে তাঁরা সেই দেশে কোনও দিন না গিয়েই লেখালিখি করেছেন, এর একটা কারণ হতে পারে যে তাঁরা মার্কিন নাগরিক হওয়ায় ভিসা পাননি বা তাঁরা ইরানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও নির্বাসিত, কোনও দিনও ফিরতে পারেননি।
ভারতীয়দের মধ্যে যাঁরা এই দেশ নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন তাঁদের একটা বড় সুবিধা হল পুরোনো সভ্যতা নিয়ে তাদের সঙ্গে একটা যোগসূত্র রয়েছে এবং ভারতের সঙ্গে ইরানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
আমরা ভিসা পেয়েছিলাম এবং সেখানে গিয়ে সত্যিকারের রিপোর্টিং করতে পেরেছিলাম।বছর দুয়েকের কম সময় আগে, তেহরানের বিদেশ দফতরের আমন্ত্রণে ইরানে যে সাংবাদিকরা গিয়েছিলেন, আমি তাঁদের অন্যতম ছিলাম এবং ইরানে ভারত যে বন্দর তৈরি করছে সেই ছব্বর বন্দরে গিয়েছিলাম। এই সুযোগে সারা বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করে ফেলতে সমর্থ হই যার মধ্যে ভারতের পড়ুয়ারাও ছিল যারা কুয়োম শহরে ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করছিল – সেই কুয়োম শহর যা হল ধর্ম-পরিচালিত শক্তির প্রাণকেন্দ্র।
যাঁদের বিপ্লবের সন্তান বলা যায়, আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করি। ক্ষমতাশালী মহিলা মাসৌমেহ এবতেকারের সঙ্গে দেখা করি, ১৯৭৯ সালে সেই বিপ্লবের সময় যিনি ছাত্রছাত্রীদের মুখপাত্র ছিলেন এবং তেহরানে মার্কিন দূতাবাস অবরোধের দায়িত্বে ছিলেন যেখানে ৫২ জন মার্কিন কূটনীতিককে ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৪৪৪দিন আটক করে রাখা হয়েছিল।
আজও পর্যন্ত এক বারের জন্যও ওই দূতাবাস অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেননি, ইরানীয়রা মার্কিনদের সতান বা শয়তান বলেই মনে করেন, সতান হল পারসি শব্দ যার কাছাকাছি ভারতীয় শব্দ হল শয়তান।
বিপ্লবের সন্তান ৫২ জন মার্কিন কূটনীতিককে ৪৪৪ দিন ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)
চল্লিশ বছর কেটে গেছে। এখন ইরানের চারজন উপরাষ্ট্রপতির একজন হলেন এবতেকার এবং তিনি এই ইসলামিক রিপাবলিকের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মহিলা। আমরা যখন তাঁর সঙ্গে কথা বললাম, তিনি ইরানের মহিলাদের বর্তমান অবস্থা ও সমস্যা সম্বন্ধে বললেন তবে বিপ্লবের দিনগুলো নিয়ে কোনও কথা বলেননি। তিনি বিশুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, কারণ তাঁর কাহিনিটা এইরকম – তাঁর বাবা পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন এবং তিনি ছ’বছর তাঁর মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায় ছিলেন।
তবে তিনি ইরানে ফিরে আসেন এবং ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন – এবং আলি শরিয়তির মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন, যিনি সমাজতত্ত্ব ও ধর্মের উপরে জোর দিয়েছিলেন এবং যাঁকে বিংশ শতাব্দীর ইরানীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে মনে করা হয়। সেই জন্যই নিজেকে চাদরে ঢেকে রাখেন এবতেকার এবং মুখটুকু খুলে রাখেন, আজও পর্যন্ত।
২০০৯ সালে মনে করা হচ্ছিল যে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন মাসৌমেহ এবতেকার, কিন্তু তিনি স্থির করেন যে তিনি এ থেকে সরে দাঁড়াবেন। সোজা কথায় তিনি বলেন যে এ নিয়ে সংবিধানে বেশ কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে এবং গার্ডিয়ান কাউন্সিল বলেছে যে কোনও মহিলার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার দৌড়ে থাকার ব্যাপারে কোনও আইনি বাধা নেই।
এখনও পর্যন্ত অবশ্য তাঁরা কোনও মহিলাকেই এই পদের জন্য ছাড়পত্র দেয়নি এবং বেশিরভাগই এই পদের দাবিদারও হন না। ঘটনা হল, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইরানীয় মহিলারাই সবচেয়ে বেশি শিক্ষিতা এবং এখানে নারীশিক্ষার হার ৮৩ শতাংশ। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাঁদের যোগদান সবচেয়ে বেশি। ঘটনা হল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ৬০ শতাংশ আসনেই মহিলারা রয়েছেন এবং শিক্ষকপদেও মহিলাদের সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি।
১৯৭৯ সালে ছাত্রছাত্রীদের মুখপাত্র ছিলেন মাসৌমেহ এবতেকার যিনি মার্কিন দূতাবাস অবরুদ্ধ করেছিলেন। (ছবি: রয়টার্স)
তবে সেই সময় থেকেই ইরান নিজেই অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে এবং ৪০ বছর ধরে এই অঞ্চল তো বটেই, পুরো বিশ্বে সমস্যা তৈরি করে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তেহরানের নাটকীয় দেওয়ালচিত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। তেহরানে আমার যে সরকারি সফরসূচি ছিল তার মধ্যে – যা ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে, যেদিন মার্কিন বন্দিরা সেই জায়গা ছেড়ে গিয়েছিলেন সেই দিন থেকে। ওই দূতাবাস এলাকাটি হল তেহরানের প্রাণকেন্দ্রে যা আজও সেই অতীতকে মনে করায়।
আমি সিদ্ধান্ত নিই যে সূচির বাইরে বেরিয়েই একবারের জন্য দূতাবাসটি দেখতে যাব – আমি কোনও দিনও সেই দূতাবাস দর্শনের কথা ভুলতে পারব না। দেওয়ালে পারসিতে লেখা আছে, “ওরে আমেরিকা, আমরা আমাদের জুতোর শুকতলায় তোকে পিষে মারব।” প্রায় কোনও রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া সেই দূতাবাসের বাগানে ইংরেজিতে লেখা কয়েকটা পোস্টারও ছিল, সেগুলো এমন ভাবে রাখা ছিল যেন বাগানে সেগুলি প্রদর্শিত করা হচ্ছে। সেখানে লেখা, “শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্যই বুঝি মানবাধিকার” এবং “সৌদি-ইজরায়েলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র” (United States of Saudi-Israeli America)। এই জায়গাটিকে “ঔদ্ধত্ববিরোধী জাদুঘর উদ্যান” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এমনিতেই এই ভবনটিকে ১৩ আবান মিউজিয়াম নামে ডাকা হত, ইসলামি পঞ্জির হিসাবে যে দিন এই ভবনটিকে দখল করেছিলেন ইরানের ছাত্রছাত্রীরা, সেই দিনের স্মরণেই এই তারিখ। এর ভিতরে ঘর ও যন্ত্রপাতিগুলিকে দূতাবাসের “গুপ্ত ও চর বিভাগ”, “নথি ধ্বংসের কক্ষ” প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করা রয়েছে। আমরা যদি আমাদের অঞ্চলের বাইরে একবারের জন্য চোখ রাখি এবং পাকিস্তানের ওপারের বিশ্বে তা হলে আমরা ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কাউকেই উপেক্ষা করতে পারব না।
একজন উন্নতি লাভ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কল্যাণে – আরেকজন নিজের অস্তিস্ত রক্ষা করছে তার বিরুদ্ধেই যাকে আমরা বলি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে