ধর্ষণে সাজাপ্রাপ্ত আসারামের শিষ্যরা গুরু-শিষ্য সম্পর্ক নিয়ে আমাদের কী শিক্ষা দেন
দরিদ্রদের কথা বলে লাভ নেই, প্রতিষ্ঠিতরাও গুরুদের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়াতে সাহায্য করেন
- Total Shares
২০১৩ সালে জেল হেফাজতে যাওয়ার পর আসারাম বাপুকে কেন্দ্র করে ভারতীয় জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। দেখতে হবে এ বার তাঁর সমর্থকরা কী করেন। নাবালিকা ধর্ষণের দায়ে বাপুর বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রশাসন আশা করেছিল যে এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হবেন আসারাম বাপু। তাই জোধপুর শহরটিকে রাতারাতি জেলখানা বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। ২১ এপ্রিল থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল।
বিচারকের জন্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এমনকি তাঁর বাসস্থানে দিনরাত প্রহরার বন্দোবস্ত ছিল। পুলিশের তরফ থেকে শহরের প্রতি হোটেলে এমনকি গাড়িতে বিশেষ নজরদারি করা হয়েছিল যাতে আসারাম বাপুর ভক্তরা শহরে ঢুকে পড়তে না পারে।
ধর্ষণ করলেও তিনি গুরুদেব। আর, ধর্ষক গুরুদেব সাজা পাচ্ছেন, বিষয়টা আমরা ঠিক পছন্দ করি না।
ধর্ষক গুরুদেবরা সাজা পাচ্ছেন, বিষয়টা আমরা ঠিক পছন্দ করি না।
তবে এ দেশে ধর্ষকদের হয়ে প্রচার তো এই প্রথমবার হয়নি। কাঠুয়া ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল বের করা হয়েছিল। এ ছাড়া উন্নাও কান্ডেও উত্তরপ্রদেশ সরকার বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেনগরকে রক্ষা করতে মরিয়া চেষ্টা করেছিল।
দেখতে দেখতে ন'মাস হতে চলল। কিন্তু আমরা এখনও গুরমিত রাম রহিম সিংকে কেন্দ্র করে দুঃস্বপ্নের কথা ভুলতে পারেনি। দুই মহিলাকে ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। এর পরেই তাঁর শিষ্যরা বেশ কিছু অঞ্চলে দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস করা হল, শ'দুয়েক লোক আহত হয়েছিল এবং আরও তিরিশ জন নিহত হয়েছিলেন।
এক্ষেত্রেও একই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াতে মুখ খোলবার চেষ্টা করেছেন তাঁদেরকে আসারামের শিষ্যদের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আসারামের শীর্ষরা দাবি তোলেন যে যারা যারা ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন তাঁদের আসারামের জামিনের পক্ষে আন্দোলন করতে হবে। ভাবতে অবাক লাগে আসারামের শিষ্যরা এমন একজনের হয়ে সওয়াল করছিলেন যিনি জেল হেফাজতে থাকাকালীনও সাক্ষী লোপাটের হুমকি দিয়েছেন।
অজয় পাল লাম্বা নামের একজন পুলিশ অফিসার এই বাবাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন যে গ্রেপ্তারের পরে তিনি দু'হাজারের অধিক হুমকি চিঠি ও ফোন পেয়েছেন। একজন ডেপুটি কমিশনার পদ মর্যাদার অফিসার হওয়া সত্বেও তিনি তাঁর সন্তানকে বেশ কিছুদিন স্কুলে পাঠানোর সাহস দেখাতে পারেননি।
এই হুমকিগুলো কেউই হালকা ভাবে নেওয়ার সাহস দেখতে পারতেন না। আসারাম মামলার তিন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আসারামের ১২ বছরের চিকিৎসকও রয়েছেন যিনি আসারামের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিলেন। আরও বেশ কিছু সাক্ষীর উপরও আক্রমণ করা হয়েছিল। সাক্ষী দিতে যাওয়ার সময় আর এক চিকিৎসককে তো জোধপুরের আদালত চত্বরেই হত্যা করা হয়েছিল।
তাঁর শিষ্যদের যখনই সন্দেহ হয়েছে যে কোনও তথ্যপ্রমাণ বা কোনও সাক্ষ্য আসারামকে দোষী সাব্যস্ত করে দিতে পারে, তারা তখনই তা মুছে ফেলতে উদ্যত হয়েছে। অন্যান্য বাবার শিষ্যদের মতোই আসারাম বাবার শিষ্যরাও বাবার অন্ধ ভক্ত।
কিন্তু কেন গুরুদেব ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করেও শিষ্যদের কাছে 'গুরু' রয়ে যান?
দরিদ্রদের আশা আর ভরসা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। এই আশা-ভরসা তাঁদের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার। তাঁরা এমন একজন মানুষের উপর ভরসা করেন যিনি তাঁদের কষ্টের কারণ ব্যাখ্যা করে দিতে পারেন এবং পরের জন্মের একটি ভালো জীবনের প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন। তবে শুধু দরিদ্রদের কথা বলে লাভ নেই। সমাজের প্রতিষ্ঠিতরাও এই গুরুদেবদের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়াতে সাহায্য করেন।
কেন গুরুদেব ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করেও শিষ্যদের কাছে 'গুরু' রয়ে যায়?
একঘেঁয়ে জীবন কাটাতে কাটাতে মানুষ উচ্চ ক্ষমতার খোঁজ করে। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে, যে প্রশ্নগুলোর উত্তর তাদের কাছে নেই, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিশ্চয় কারও না কারও কাছে রয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে তাঁরা যা কিছু পাননি সে সব কিছুই পাইয়ে দেওয়ার যোগ্যতা কারও না কারও রয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে আনন্দের চাবিকাঠি কারও না কারও হাতে রয়েছে।
২০১১ সালে দীপক চোপড়া নামক এক ভন্ড যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের রোগ নিরাময়ের প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করেছিলেন। সম্প্রতি একটি তথ্যচিত্রে দেখান হয়েছে ওশো ভক্তরা কী ভাবে তাঁদের প্রশ্নের উত্তরগুলো খুব সহজেই পেয়ে যান এবং তাদের উপযুক্ত পথেরও সন্ধান পেয়ে যান। কখনও সেই পথ মাদকাসক্ত হয়ে উঠতেও অনুপ্রাণিত করে।
পুরোটাই সময়ের (পড়ুন খারাপ সময়ের) উপর নির্ভর করছে। বছর পাঁচেক আগে আমার এক বন্ধু তাঁর বাবা-মার পরামর্শে স্বামীকে নিয়ে এক গুরুর কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু যজ্ঞ করবার অজুহাতে মোটা টাকা অনুদান চেয়েছিলেন সেই গুরুদেব। এর পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এতটাই অবনতি হয় যে তাদের বিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়ে যায়।
বিশ্বাস কিন্তু মানুষকে ধোঁকা দেয়। আপনি দূর থেকে তা বুঝতেও পারবেন না।
ওশোকে নিয়ে সেই তথ্যচিত্রটিতে দেখে কারও মনে হতেই পারে যে এটি এক নিপাত নির্বোধ লোকের কাহিনি যিনি একজন মহিলাকে বিশ্বাস করে তাঁর সমস্ত কিছু দিয়ে দিয়েছিলেন এবং পরে মহিলাটি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলে তাঁর আর কিছুই করবার ছিল না। অনেকেই আবার সেই নির্বোধ লোকটির মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছিলেন।
লোকে তাঁকে ঈশ্বর বলে সম্বোধন করেন। এবং তাঁর নামের জন্য নিজেদের জীবন দেন করতেও প্রস্তুত। নিঃসন্দেহে, রাম রহিম বা আসারামের থেকে ওশোর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। গোটা বিশ্ব জুড়েই তাঁর ভক্তরা ছড়িয়ে। তিনি মানুষের এমন স্বাধীনতা দিয়েছেন যে তাঁর বিনিময়ে মানুষ তাঁকে মোটা অঙ্কের অনুদান দিতে কখনও পিছপা হননি।
গত চার দশকে প্রচুর প্রতিপত্তি অর্জন করেছেন আসারাম। কংগ্রেস ও বিজেপি দুটি দলই তাঁকে সাহায্য করেছে। তাঁকে আশ্রমের জন্য জমি দান করেছে। এখন তো তাঁর ১০,০০০ কোটি টাকার সাম্রাজ্য। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর শিষ্যরা কোনও দিনও মাথা ঘামাননি। কিন্তু ২০০৮ সালে তাঁর আবাসিক স্কুলে যখন দুটি নাবালক শিশুর ছিন্নবিচ্ছিন দেহ পাওয়া গেল তখনই তাঁর উপর প্রথম সন্দেহ করা শুরু হল। কালা জাদুর জন্যই তাদের নাকি মেরে ফেলা হয়েছিল।
যে মেয়েটি ধর্ষণের মামলা করেছিল তার মা-বাবা তাকে আসারামের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন যে তাঁদের মেয়েকে ভূতে ধরেছিল। ভূত তাড়াবার নাম তাঁকে ধর্ষণ করেছিলেন আসারাম। কে জানে, এর আগে আর কত মেয়ের সর্বনাশ তিনি করেছেন!
অন্ধ বিশ্বাসের কোনও ওষুধ নেই। একমাত্র শিক্ষার দ্বারা এই সব বিশ্বাস দূর করা সম্ভব। কিন্তু এই শিক্ষাদান যাঁরা করতে পারতেন তাঁদের হটাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো সদলবলে উঠেপড়ে লেগেছেন। ভারতীয়দের কাছে শিক্ষালাভের একমাত্র রাস্তা তাহলে হোয়াটস অ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়। যতদিন শিক্ষা সম্পূর্ণ না হচ্ছে আমরা কালা জাদু আর ভূতে বিশ্বাস করেই যাব আর আমাদের জন্য রাম রহিম ও আসারাম বাবুরা তো থাকবেনই।