গান্ধীনগর থেকে অমিত শাহের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চমক নেই, এটাই বিজেপির স্মার্ট রাজনীতি
বারে বারে যোগ্যতা দেখিয়েছেন অমিত শাহ, তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা এখন দীর্ঘমেয়াদি
- Total Shares
অমিত শাহ গান্ধীনগর কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন বলে বাতাসে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও অমিত শাহ প্রার্থী হওয়ার মধ্যে একটা চমক ছিল, কারণ তিনি রাজ্যসভার সাংসদ এবং বিজেপির অন্যতম প্রধান ভোট-প্রচারকারী, তাই তিনি নিজেকে কোনও একটা জায়গায় আবদ্ধ রাখবেন না বলেই অনেকে মনে করেছিলেন।
তবে একটু ভালো ভাবে খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে অমিত শাহের এই সিদ্ধান্তের পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
গান্ধীনগর লোকসভা আসন থেকে অমিত শাহের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার একটা প্রধান কারণ হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাট থেকে যথাসম্ভব বেশি আসন জয়ের ব্যাপারে বিজেপি যে প্রচার করছে তা ভালো ভাবে তুলে ধরা। দলটি আপাত ভাবে মনে করছে যে নির্বাচনী তালিকায় ওজনদার প্রার্থীর সংখ্যা যত বেশি হবে, তাদের এই উদ্দেশ্যও তত সুচারু ভাবে পূরণ হবে। অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছেন, “রাজ্য বিজেপি ও আরএসএস-এর শক্তির উপরে সত্যিকারের জোশ এনে দেওয়ার জন্যই রাজ্যের ভোট ময়দানে প্রবেশ করেছেন অমিতজি – এর কারণই হল গত বারের মতোই এই রাজ্যের ২৬টি লোকসভা আসনের প্রতিটিতে জয়ের লক্ষ্যে স্থির থাকা।”
এ ছাড়াও তাঁর ওই ক্ষমতাশালী ভাবমূর্তি ধরে রাখার জন্য শাহ মনে করছেন তাঁর সাংসদ হওয়া জরুরি, তবে সেটি রাজ্যসভার মাধ্যমে নয়, লোকসভার মাধ্যমে – আরও ভালো ভাবে বলতে গেলে, দলীয় সভাপতি হিসাবে অমিত শাহের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে এবং তার পরে তিনি নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারবেন। ২০১৯ সালে বিজেপি নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি অর্থ, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য অথবা গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী হতে পারেন।
তাঁর যে কাজ করার মতো দক্ষতা ও যোগ্যতা রয়েছে তা গুজরাটে দেখা গিয়েছিল যখন তিনি গ্রামোন্নয়নের মতো দফতর সামলেছেন – এই দফতরটি সামাজিক ভাবে তো বটেই, রাজ্যগুলির নিরিখেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে আজকের দিনের চটকদার রাজনীতিতে এই বিষয়টিকে লঘু করে দেখা হয়। গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় ১৭টি দফতর সামলেছেন অমিত শাহ এবং প্রতিটি দফতরই সামলেছেন প্রবল দক্ষতার সঙ্গে। গুজরাটের পরিবহণমন্ত্রী হিসাবে চিরকাল লোকসানে চলা গুজরাট স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনকে লাভজনক সংস্থায় পরিণত করেন।
এখন লোকসভার মাধ্যমে সংসদে প্রবেশ করতে চান অমিত শাহ। তাঁর এই পদক্ষেপের মধ্যে কি দীর্ঘমেয়াদী কোনও ভাবনা রয়েছে (উৎস: ইন্ডিয়াটুডে.ইন)
মোদীকে যে প্রশ্নটি তাড়া করে বেড়াচ্ছে সেই প্রশ্নটিও অমিত সাহের মাথায় থাকতে পারে, নরেন্দ্র মোদীর তাঁর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের অনেকেই রাজ্যসভার সদস্য – যে তালিকায় রয়েছেন অরুণ জেটলি, পিযূষ গয়াল, ধর্মেন্দ্র প্রধান থেকে নির্মলা সীতারমণ। অমিত শাহ হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই লোকসভার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে চাইছেন। বারাণসীকে যেমন মোদীর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করা হচ্ছে ঠিক সেই ভাবেই অমিত শাহের জন্য গান্ধীনগরের থেকে নিরাপদতর আসন আর নেই – ১৯৮৯ সাল থেকে কোনও দিনও এই আসনে বিজেপি পরাজিত হয়নি।
এমনকি ১৯৯৬ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠায় (পরে সেই অভিযোগ থেকে তিনি বেকসুর মুক্তি পান) নৈতিক কারণে যখন লালকৃষ্ণ আডবাণী সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন তখন তুলনায় অনেক সাধারণ একজন বিজেপি প্রার্থী হিসাবে আইনজীবী বিজয় পটেল এই আসনে ৬০,০০০ ভোটে পরাজিত করেন কংগ্রেসের তারকা প্রার্থী রাজেশ খান্নাকে। তাই নির্বাচনের সময়ে মাত্র একবার বা দুবার এই কেন্দ্রে ভোটের প্রচার করেই এই আসনে তাঁর পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব, তাই বাকি সময়টা তিনি সারা দেশে প্রচারের জন্য দিতে পারবেন।
গুজরাটের স্থানীয় বিভিন্ন ইস্যুর জন্যও অমিত শাহ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আনন্দীবেন প্যাটেলের উত্তরসূরী হিসাবে বিজয় রূপানি নির্বাচিত হওয়ার পরে রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী নীতিন পটেল এবং পটেলদের জন্য সংরক্ষণের যাঁরা দাবিদার তাঁদের নেতা হার্দিক পটেল (যিনি সম্প্রতি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন) অমিত শাহের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন পটেলদের বঞ্চিত করার জন্য, নীতিন পটেলকে সুযোগ না দেওয়ার অমিত শাহের নামে ‘পটেল-বিরোধী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছিল।
অমিত শাহকে ‘পটেল-বিরোধী’ বলে তকমা দিয়েছিলেন হার্দিক পটেল, তাই ‘পটেলদের আসন’ বলে পরিচিত গান্ধীনগর আসন জয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।(উৎস: রয়টার্স)
অতীতে চিরকালই পটেলদের শক্তিকেন্দ্র সরখেজ থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে এসেছেন অমিত শাহ, তাও তাঁর বিরুদ্ধে অত্যন্ত কুৎসিত ও কদার্য ভাবে প্রচার করা হয়েছিল। তাঁর পুত্রবধূও পটেল গোষ্ঠীরই। তা সত্ত্বেও বিজয় রূপানি-নীতিন পটেলের ঘটনাক্রম তুলে ধরে পটেলদের মধ্যে অমিত শাহকে ‘পটেল-বিরোধী’ বলে প্রচার করে কিছুটা হলেও সফল হয়েছিলেন হার্দিক। শহরাঞ্চল হোক বা গ্রামাঞ্চল, গান্ধীনগরে বিপুল সংখ্যায় পটেলদের ভোট রয়েছে, তাই তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিরোধীদের তোলা অভিযোগের জবাব দিতেই ‘পটেল-আসন’ থেকে জয়ী হতে চান ‘অমিত শাহ’।
সব শেষে যে কথা বলা যায়, তা হল অমিত শাহের বয়স মেরেকেটে ৫৫ বছর – তাই এখনও দীর্ঘ মেয়াদে নির্বাচন এবং একই সঙ্গে দলকে সামাল দেওয়ার কথা ভেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেন, ইতিমধ্যেই দলের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে যে উত্তরপ্রদেশ ও অসমে লোকসভা নির্বাচন এবং তার পরে হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের কারিগর তিনিই। হিন্দুত্ববাদের গভীরতা, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ নিয়ে আরএসএসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর জ্ঞান অতীব গভীর। আর এই সব কারণেই আরএসএসের অন্দরে তিনি যথেষ্ট ওজনদার।
মোদী সরকারের অগ্রণী প্রকল্পগুলি তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে – এর মধ্যে সর্বশেষ উদাহরণ হল আয়ুষ্মান ভারত। তাই হতে পারে যে অমিত শাহ মনে মনে একটা ছবি এঁকেছেন – যেটা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গও বটে – নরেন্দ্র মোদী পরবর্তী যুগে তাঁর নিজের বৃহত্তর ভূমিকা নিয়ে, হয়তো এক দশক পরের ভাবনাই তাঁর মনে রয়েছে। এ ছাড়া নরেন্দ্র মোদী নিজেও তাঁকে নিজের মতো করে গড়ে নিতে চাইছেন সব দিক বিবেচনা করেই।
স্পষ্টতই, যাঁরা ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক রূপরেখা নিয়ে অবগত, তাঁরা রাজ্যসভার সদস্য থাকা অবস্থায় অমিত শাহের লোকসভায় প্রবেশের সিদ্ধান্তে মোটেই আশ্চর্য হবেন না।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে