জমি আন্দোলনের নেতা অলীক চক্রবর্তী ধৃত: শাসকদলের বিরোধিতা করা মানেই কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা?
কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, শাসকদলের বিরোধিতা করলেই কড়া ধারা প্রয়োগের আশঙ্কা
- Total Shares
শাসকদলের বিরোধিতা করা মানেই কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা? ভাঙড়ে জমি আন্দোলনের নেতা অলীক চক্রবর্তী ইউএপিএ আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্টে গ্রেপ্তারির পরে এই প্রশ্নই উঠতে বাধ্য। এক সময় যে জমি আন্দোলনের জেরে এই রাজ্যের মসনদে বসেছে তৃণমূল সরকার, এখন সেই জমি আন্দোলনের জন্যই রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা সেঁটে অন্য রাজ্য থেকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে এমন একজনকে।
কানহাইয়া কুমারের সময়ে গেল গেল রব উঠলেও এখনও অবশ্য সিপিএম ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দলকে সে ভাবে মুখ খুলতে শোনা যাচ্ছে না। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “রাজ্যে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার ভুলুণ্ঠিত করার আরও একটা উদাহরণ হয়ে উঠল ভাঙড় আন্দোলনের সংগঠক অলীক চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা। তিনি চিকিৎসার জন্য ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। যদি কোনও ব্যক্তি পুলিশ প্রশাসনে চক্ষুশূলও হন তখনও তাঁকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার উচিৎ।” অলীক চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ শুরু হয়েছে।
অলীক চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
কিছুদিন আগেও সিপিআই (এমএল) রেড স্টার দলের মতোই এই দলের নেতা অলীক চক্রবর্তীর নামও অজানা ছিল। তাঁর নাম লোকে জানল ভাঙড়ে জমি আন্দোলনের জেরে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সাবস্টেশন গড়ে তার মাধ্যমে বিহারের পূর্ণিয়া থেকে বিদ্যুৎ এনে তা দুই ২৪ পরগনা ও রাজারহাটে বণ্টনের পরিকল্পনা করে কেন্দ্রীয় সরকার। সে জন্য ভাঙড়ের পোলেরহাট ২ নম্বর গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায় সাবস্টেশনও তৈরি হয়। সমস্যা শুরু হয় ২০১৬ সালের জুন-জুলাই মাস নাগাদ। মাছিভাঙা, খামারআইট, টোনা, ডিবডিবা প্রভৃতি গ্রামের মানুষ এই জনবহুল এলাকার মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের তার নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি শুরু করেন। ওই বছর নভেম্বর মাসেই খুঁটি বসানোকে কেন্দ্র করে পাঁচ জন মহিলা-সহ মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারপর থেকে ধৃতরা জামিনই পাচ্ছিলেন না। এই সময়েই অলীক চক্রবর্তী ও তাঁরই দলের নেত্রী শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর সঙ্গে গ্রামের লোকজনের আলাপ হয়। আন্দোলনে যোগ দেন অলীকরা।
২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি জমি আন্দোলনের জেরে হাজার দশেক গ্রামবাসী হাড়োয়া রোড অবরোধ করেন। পুলিশ অবরোধ তুলতে এলে শুরু হয় অশান্তি। বেধে যায় সংঘর্ষ। গুলিতে নিহত হন মোফিজুল ইসলাম ও আলমগীর মোল্লা নামে দুই গ্রামবাসী। অভিযোগ, পুলিশের গুলিতেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মৃত্যুতে ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে। তৈরি হয় জমি জীবিকা, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি। নেপথ্যে নেতৃত্ব দিতে থাকেন অলীক। তাঁর নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতা-সহ ৬৫টি মামলা দায়ের করে পুলিশ।
ভাঙড়ে জমি আন্দোলনের নেতা অলীক চক্রবর্তী (সুবীর হালদার)
We demand unconditional release of Aleek Chakraborty, the leader of Bhangar movement arrested under UAPA while he was at Bhubaneswar for treatment. The by-election mandate can't legitimize the arrest and killings there. The struggle shall continue.
— Surjya Kanta Mishra (@mishra_surjya) 31 May 2018
যে জমি আন্দোলন একদিন রাজ্যের জমি কেড়েছিল সিপিএমের, সেই সিপিএম তো বটেই, বাম মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন দল, কংগ্রেস, আক্রান্ত আমরা এবং মানবাকধিকার সংগঠন এপিডিআরের নেতারা ভাঙড়ের আন্দোলনকারীদের কাছে যাতায়াত শুরু করলেন। ততদিনে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে গেছে এই সব আন্দোলনরত গ্রাম। মাঝেমধ্যে দু’একটা মিছিল হয়, তবে আন্দোলন ধীরে ধীরে কার্যত ধামাচাপা পড়ে যায়। মোটামুটি একটা স্থিতাবস্থা তৈরি হয়ে যায় এই সব গ্রামে।
তবে ভোট আসতেই পরিস্থিতি বদলে যায়। নির্দল প্রার্থী হিসাবে জমি আন্দোলনকারীরা প্রার্থীদের মনোনীত করে। সেই প্রার্থীরাই অবরুদ্ধ অবস্থায় হোয়াটসঅ্যাপে মনোনয়ন জমা দেন। ভোটের ফল বার হলে দেখা যায় জয়ীদের তালিকাতেও তাঁদের কয়েকজন রয়েছেন। এখনও পঞ্চায়েত ভোট প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হয়নি, তার মধ্যেই অলীক চক্রবর্তীর গ্রেপ্তারি।
ভাঙড়ে আন্দোলন (ফাইল চিত্র)
প্রশ্ন হল, অলীক চক্রবর্তী কি সত্যিই দেশদ্রোহী? দেশদ্রোহী কাকে বলে? গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাঁচ বছরের জন্য যে রাজনৈতিক দল সরকার চালাচ্ছে তার বিরোধিতা করা মানেই কি দেশদ্রোহিতা? নাকি বিরোধী মত সহ্য করতে না পারা, মানে অসহিষ্ণুতার মূল্য চোকাতে হয় এমন গুরুতর ধারায় অভিযুক্ত হয়ে? যে দল জনাদেশ পেয়ে শাসনভার গ্রহণ করেছে, সংবিধানে বর্ণিত ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা (বাকস্বাধীনতাও তারই অঙ্গ) রক্ষার কোনও দায় কি তার নেই? তা হলে শপথবাক্যে যে বলা হয় ভারতের সংবিধানের প্রতি অকপট শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা পোষণ করিব সেটা কি স্রেফ নিয়মরক্ষা বা কথার কথা? শাসকদলের প্রতীক আর শাসকের মুখ বদলায়, শাসনের ধারাটা বদলায় না!