জরুরি শাসন: ভীমা করেগাঁও মামলায় সমাজকর্মীদের গ্রেপ্তার ভারতীয় গণতন্ত্রের এক কালো অধ্যায়
সামনে লোকসভা নির্বাচন, ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে আতঙ্কে ভুগছে সরকার
- Total Shares
অনেক ভারতীয়ই মনে করেন যে মধ্য সত্তরের জরুরি অবস্থার সময়টাই স্বাধীনোত্তর ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচাইতে কালিমালিপ্ত সময়কাল। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে আমার চারপাশের পরিবেশ কতটা থমথমে ছিল এবং লোকে কতটা আতঙ্কে ভুগতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি কয়েকজনকে চিনি যাদের সেসময় বিনা কারণে জেলও খাটতে হয়েছিল। তাই কিছুদিন আগে অবধি আমিও বিশ্বাস করতাম যে জরুরি অবস্থার সময়টাই স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে কালিমালিপ্ত সময় সময় ছিল। কিন্তু, এখন আমার ধারণা বদল হয়েছে।
এর কারণ, বর্তমানে ভারতে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে সেগুলো জরুরি অবস্থার মতোই ভয়াবহ, কিছু ক্ষেত্রে তার চাইতেও খারাপ।
জরুরি অবস্থার সময় রাষ্ট্র নিজের ক্ষমতা প্ৰয়োগ করে বহু নিরীহ লোকের উপর নির্যাতন চালিয়ে ছিল কারণ তাঁরা আইনের মধ্যে দিয়ে সমাজের দরিদ্র্য, উৎপীড়িত ও নিপীড়িত মানুষদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়ে ছিলেন। এখনও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
জরুরি অবস্থা চলাকালীন গ্রেপ্তার হওয়ার পর জর্জ ফার্নান্ডেজ [ছবি:ইন্ডিয়া টুডে]
কিন্তু জরুরি অবস্থার সময় আমরা যে ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করেছি এখন তার চাইতেও ভয়ঙ্কর ঘটনা হামেশাই ঘটে চলেছে। একদল লোক যাদের চিন্তাধারা শাসকদলের চিন্তাধারার সঙ্গে মেলে তারা হিন্দুত্বের নামে প্রায়ই প্রতিবাদকারীদের হুমকি দিচ্ছে, গণধোলাই দিচ্ছে এমনকি খুনও পর্যন্ত করে দিচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া তো দুরস্ত, উল্টে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তাদের হয়ে গুণকীর্ত্তন করে চলেছেন। সব দেখে শুনেও দেশের প্রধানমন্ত্রী এক হয় মৌনব্রত অবলম্বন করে থাকেন, না হয় গোল গোল কথা বলেন। এর ফলে এই ভয়াবহ শক্তিগুলোর সাহস উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী চাপ থাকতেই বেশি পছন্দ করে [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
সংবাদপত্রের পাতায় এখন যে মিথ্যে খবরগুলো প্রকাশিত হয় তা কিন্তু আমাদের জরুরি অবস্থার সময়কার ঘটনাগুলোকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সময় প্রকাশিত হওয়ার মিথ্যে খবরগুলোর চরিত্রটা কিন্তু অনেকটাই ভিন্ন। সেই সময় সংবাদমাধ্যম নিয়ে এতটা কাটাছেড়া হতো না, তাই বোধহয় খবরগুলো খুব সহজে প্রকাশ করা যেত। কিন্তু এখন তো সংবাদমাধ্যম নিয়ে কাটাছেঁড়ার কোনও অন্ত নেই। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা চাকরি হারাবার আতঙ্কে ভোগেন। তাঁরা জানেন যে কোন কোন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করা যাবে না আর আর তাই একটি ঘটনাকে প্রয়োজন মতো বদলে ফেলে তা খবর হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
ভীমা করেগাঁওতে অশান্তির সময় [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
বর্তমান অন্ধকার সময়ের সবচাইতে ভয়াবহ ঘটনাটি মঙ্গলবার, মানে ২৮শে আগস্ট, ঘটেছে। গতবছর ৩১ ডিসেম্বর ভীম করেগাঁও দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে সেদিন পুনে পুলিশ দেশজুড়ে সাহিত্যিক, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছেন।
সুধা ভরদ্বাজ একজন সম্মানীয় আইনজীবী [ছবি: টুইটার সৌজন্যে]
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোও বেশ ভয়ঙ্কর - তাঁরা নাকি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে সমর্থন করেছেন, তাঁরা নাকি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে আর্থিক সাহায্য করেছেন, বেআইনি কাজ করেছেন এবং অপরাধমূলক চক্রান্ত করেছেন। আসল সত্যতা হচ্ছে ঘটনার দিনে এরা কেউই পুনেতে উপস্থিত ছিলেন না। ঘটনার পর পরই যে মামলা রুজু করা হয়েছিল সেই মামলায় কোথাও এদের নাম ছিল না। অথচ, সেদিনের ভিডিওতে যে সব লোককে ঝামেলার সময় দেখা গিয়েছিল তাদের কারুর টিকি ছুতে পারেনি পুলিশ। এর আগে মে মাসেও পাঁচজনকে একই কারণ দেখিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়ে ছিল। তারা এখন জেল হাজতে রয়েছেন।অথচ পুনে পুলিশ এখনও অবধি তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করতে পারেনি।
যে হাস্যকর কারণ দেখিয়ে গ্রেপ্তারগুলো করা হয়েছে তা প্রমান করা অত সহজ নয়। হরিয়ানার একটি আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট পুনে পুলিশের আট সদস্যের একটি দলকে সুধা ভরদ্বাজকে গ্রেপ্তারের সঠিক কারণগুলো জিজ্ঞেস করেছিলেন। আটজনের একজনও ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।
সনাতন সংস্থার মতো হিন্দু সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
তাঁরা শুধু মারাঠি ভাষায় লেখায় একটি কাগজ দিয়েছিলেন যেখানে বিভিন্ন ধরণের অপরাধের মামলায় কাজ করার প্রক্রিয়াগুলো লেখা ছিল। কিন্তু যাকে গ্রেপ্তার করা হবে তিনি ঠিক কী অপরাধ করেছেন তা তাঁরা আদালতকে জানাতে পারেননি।
এই লোকগুলোর পরিচয় কী যাদেরকে রাষ্ট্র ভয়ঙ্কর বলে প্রমান করবার চেষ্টা করছেন?
এদের মধ্যে রয়েছেন সুধা ভরদ্বাজ। ইনি একজন বিশিষ্ট ও সম্মানিত আইনজীবী। প্রায় দু'দশক ধরে তিনি শ্রমজীবী, বাস্তুহীন ও দরিদ্র লোকদের জন্যে আইনি লপ্রায় লড়ছেন। আইআইটি থেকে পাস করেও তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েই গোটা জীবন লড়াই করে গেলেন। বর্তমানে, তিনি দিল্লির ন্যাশনাল ল' ইউনিভার্সিটিতে পড়ান।
এর পর রয়েছেন ভারভারা রাও। ইনি তেলেগু ভাষার একজন বিখ্যাত কবি ও সমাজসেবী। তেলেঙ্গনায় বেশ কয়েকটি শান্তি প্রক্রিয়া তাঁর হাত ধরেই সম্পন্ন হয়েছে। এই দলের রয়েছেন ইকোনমিক ও পলিটিক্যাল উইকলির প্রাক্তন সম্পাদক গৌতম নওলাখা যিনি বেশ কয়েক দশক ধরেই সামাজিক মুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। এছাড়া তালিকায় রয়েছেন প্রযুক্তিবিদ আনন্দ তেলতাম্বে যিনি গোয়াতে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।অন্য দেশের এই ধরণের নাগরিকরা নিজেরদের কর্মের জন্যে যথাযথ সম্মান পেয়ে থাকেন।
কিন্তু এদেশে ওদেরকে অপরাধী প্রমান করতে সকলে মরিয়া কেন?
এক্ষেত্রে সময়টা খুব গুরত্বপূর্ন।
প্রথমত এর আগে মহারাষ্ট্রে আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং চার্জশিট পেশের নব্বইদিনের সময়সীমা প্রায় শেষ হতে চলল। ধরে নেওয়াই যেতে পারে যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে এখনও নির্দিষ্ট কোনও তথ্যপ্রমান জোগাড় করা যায়নি। সে ক্ষেত্রে আরও কিছু লোককে গ্রেপ্তার করে তদন্তের আছিলায় আরও কিছুদিন গারদে আটকে রাখার আর্জি জানান যেতেই পারে। আরও, একটি কারণে এই নাটক রচনা করা হয়েছিল। যারা সত্যিই দোষী তাদের উপর থেকে প্রচারের আলো সরিয়ে ফেলার জন্যে।
অন্য দেশের এই ধরণের নাগরিকরা নিজেরদের কর্মের জন্যে যথাযথ সম্মান পেয়ে থাকেন।
সকল অভিযুক্তই সমাজে খুব সম্মানীয়
কিন্তু এদেশে ওদেরকে অপরাধী প্রমান করতে সকলে মরিয়া কেন?
এক্ষেত্রে সময়টা খুব গুরত্বপূর্ন।
প্রথমত এর আগে মহারাষ্ট্রে আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং চার্জশিট পেশের নব্বইদিনের সময়সীমা প্রায় শেষ হতে চলল। ধরে নেওয়াই যেতে পারে যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে এখনও নির্দিষ্ট কোনও তথ্যপ্রমান জোগাড় করা যায়নি। সে ক্ষেত্রে আরও কিছু লোককে গ্রেপ্তার করে তদন্তের আছিলায় আরও কিছুদিন গারদে আটকে রাখার আর্জি জানান যেতেই পারে। আরও, একটি কারণে এই নাটক রচনা করা হয়েছিল। যারা সত্যিই দোষী তাদের উপর থেকে প্রচারের আলো সরিয়ে ফেলার জন্যে।
তৃতীয়, লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। তার আগে সরকারের বিরুদ্ধে যারা মুখ খুলবে তাদের প্রতিবাদকে দমিয়ে দেওয়ার জন্যেই এই গ্রেপ্তার।একটা বিষয় পরিষ্কার যে শাসক দল এখন ভয় ভয় রয়েছে। জিএসটি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একের পর এক ভুল করে চলেছে এবং সরকার বুঝতে পেরেছে যে সাধারণ মানুষ তাদের এই ভুলগুলো খুব ভালো চোখে দেখছে না। এই ব্যর্থতাগুলো যত প্রকাশ পাবে সরকারের ক্ষমতায় ফিরে আসা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তাই তো সরকার মরিয়া হয়ে মরিয়া পদক্ষেপ নিতে উদ্যত হচ্ছে। এর ফলে দেশের গণতন্ত্র কতটা প্রভাবিত হয়, নাকি দেশে আবার জরুরি শাসন চালু হয়ে যায় তা জানতে আমাদের এখন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে