গোর্খারা চৌকিদার বলে পরিচিত, তাঁদের সমর্থন কি 'চৌকিদার' নরেন্দ্র মোদী পাবেন?
ব্রাহ্মণ বলে চৌকিদার হতে পারবেন না সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, তিনি শ্রমের মর্যাদা দিতে জানেন না
- Total Shares
জন্মসূত্রে একজন গোর্খা হিসাবে সর্বদাই আমাকে শুনতে হয়েছে গোর্খা মাত্রেই পেশাগত ভাবে সে একজন চৌকিদার। মজা করে যাঁরা এ যাবৎ গোর্খাদের চৌকিদার বলে সম্বোধন করতেন তাঁরাই এখন নিজেদের টুইটার হ্যান্ডেলে 'চৌকিদার' শব্দটি ব্যবহার করে চলেছে। তাঁদের এই নামের আগে 'চৌকিদার' শব্দটি জুড়ে দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী 'চৌকিদার' নরেন্দ্র মোদী। বিজেপির তরফ থেকেও 'ম্যায় ভি চৌকিদার' প্রচার শুরু করা হয়েছে।
তাঁদের এই মজা করার প্রবণতা আমাকে অবশ্য কোনও দিনও লজ্জায় ফেলতে পারেনি। আমার কাছে গোর্খা মানে হচ্ছে, একটি সাহসী জাতি যাদের উপর ভরসা করা যায় এবং বিশ্বাস রাখা যায়। অর্থাৎ রক্ষাকর্তা কিংবা চৌকিদার হিসেবে গোর্খারা আদর্শ। এর উপর আমার পরিবার, স্কুল ও সম্প্রদায়ের তরফ থেকে আমাকে সর্বদাই শ্রম ও শ্রমিকদের সম্মান করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সুব্রহ্মন্যম স্বামীর মতো কিছু বিজেপি নেতা হয়তো কোনও দিনও শ্রমের বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝবেন না। সুব্রহ্মন্যম স্বামী তো অবলীলাক্রমে জানিয়েছেন, "আমি একজন ব্রাহ্মণ। তাই আমি কোনও দিনও চৌকিদার হতে পারব না।"
বিরোধীরা 'চৌকিদার হি চোর হ্যায়' মার্কা একটি পাল্টা প্রচার শুরু করে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে এই ইস্যুটি নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিয়েছে।
এর ফলের সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে 'চৌকিদার' শব্দটি বহুল ব্যবহৃত এবং একে অপরকে অবমাননা করার মতো একটি শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর, এখান থেকেই আবার প্রমাণিত হচ্ছে যে ভারত জুড়ে লোকে কী ভাবে পারিবারিক পরিচয়, পেশাগত পরিচয়, জাত, ভাষা, ধর্ম ও অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে বিভক্ত।
আমি যখন আমার বাড়ি ও আমার সম্প্রদায়ের লোকজনকে ছেড়ে অন্য শহরে বাসা বাঁধলাম তখন বুঝলাম যে গোর্খাদের উদ্দেশ্যে কটূক্তি করার জন্য বাহাদুর (যার প্রকৃত অর্থ সাহসী) শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গোর্খাদের যে শুধুমাত্র চৌকিদার হিসেবেই দেখা হয় তা প্রথমে আমি একটি কোল্ড ড্রিঙ্কসের বিজ্ঞাপন দেখে বুঝতে পারি। আমার অন্যতম প্রিয় অভিনেতা অমির খানকে সেই বিজ্ঞাপনে 'ও, সাব-জি' বলে মজা করতে দেখা গিয়েছে। যে বাচনভঙ্গিতে অমির খান বিজ্ঞাপনে কথাগুলো বলেছিলেন সেই বাচনভঙ্গি তো আমাদের সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য।
ছোটবেলায় আমি বিজ্ঞাপনটি দেখে হেসে ছিলাম। এমনকি অমির খানকে আমার সম্প্রদায়ের লোকেদের মতো উচ্চারণ করতে দেখে গর্ববোধও করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের দেশের গণমাধ্যম, এমনকি বলিউডও, গোর্খাদের শুধুমাত্র চৌকিদার রূপে দেখাতেই পছন্দ করে।
কিন্তু সেই চৌকিদার শব্দটি এখন কী ভাবে বিজেপির যুদ্ধ হুঙ্কার হয়ে দাঁড়াল?
তার মানে কি ২০১৯ সালে গোর্খারা, যাদেরকে এতদিন শুধুমাত্র চৌকিদার হিসেবে মনে করা হত, আওয়াজ তুলতে পারবে? বহু বছর ধরে চলে আসা তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের তকমা কি শেষ পর্যন্ত কি মুছে যাবে?
দুর্ভাগ্যবশত, দু'টোর কোনওটাই হবে না।
তৃণমূল সরকার যখন পাহাড় আক্রমণ করছিল তখন স্থানীয় সাংসদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না [ছবি: রয়টার্স]
দার্জিলিঙের সাংসদ বিজেপি নেতা এসএস আলুওয়ালিয়া কিন্তু তাঁর নামের আগে 'চৌকিদার' শব্দটি ব্যবহার করছেন না। আমার মতে, গত পাঁচ বছরে সাংসদ হিসেবে তিনি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ এবং কোনও ভাবেই তাঁকে তাঁর কেন্দ্রের রক্ষাকর্তা বলা যাবে না। ২০১৭ সালে পাহাড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, পাহাড়ে আগুন জ্বলেছিল, পাহাড়ের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল এবং ১০৫ দিন ধরে চলা ঐতিহাসিক বনধের সাক্ষী থেকেছিল পাহাড় - কিন্তু তা সত্ত্বেও আলুওয়ালিয়াকে টলানো যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার যখন আমাদের উপর আক্রমণকে নিয়ম করে ফেলেছিল তখন কিন্তু সাংসদ আলুওয়ালিয়াকে কোথাও দেখা যায়নি।
গোর্খাল্যান্ড নামের পৃথক রাজ্যের দাবি তো শতাব্দী প্রাচীন। কিন্তু এখনও সেই দাবি পূরণ করা হয়নি। পর পর দু'বার দু-দু'জন বিজেপি নেতাকে -প্রথমে যশবন্ত সিং ও পরে আলুওয়ালিয়া - দার্জিলিং থেকে সাংসদ নির্বাচন করার পরেও।যশবন্ত সিং কিন্তু ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে খুলেআম গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে সমর্থন করেছিলেন।
উল্টোদিকে, নিজেদের মধ্যে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পরে আঞ্চলিক দলগুলোও ব্যর্থ হয়েছে। গোর্খাল্যান্ড ইস্যু করে তারা শুধু মাত্র নিজেদের পকেট ভর্তি করে গিয়েছে।
গোর্খাল্যান্ডের দাবি শতাব্দী প্রাচীন, তা এখনও পূরণ হয়নি [ছবি: রয়টার্স]
নিজে ঘর ছেড়ে অন্য শহরে আসার পর থেকে আমার পরিচয় নিয়ে বহুবার প্রশ্ন উঠেছে। সংবাদমাধ্যমে কাজ করা আমার বন্ধু বা সহকর্মীরাও আমাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে আমার শহর দার্জিলিং কি উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলোতে অবস্থিত! দার্জিলিং কি আদৌ ভারতের অংশ - এই প্রশ্নও অনেকের মধ্যে ছিল। আমি যদি বলি যে আমার মাতৃভাষা নেপালি সঙ্গে সঙ্গে সকলে ধরে নেয় যে আম নেপালি। যদিও নেপাল থেকে ভারতে চলে আসার একটা রেওয়াজ রয়েছে কিন্তু ভারতীয় গোর্খারা তো ভারতের ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু, বহু প্রজন্ম ধরে ভারতে কাটানো গোর্খাদের এখনও বহিরাগত হিসেবে দেখা হয়।
২০১৯ সালের মোদী ভক্তরা হঠাৎ মাথায় তিলক কেটে বুক ফুলিয়ে নিজেদের চৌকিদার বলে মনে করছেন। এঁদের অনেকের পরিবারকে হয়ত সাতচল্লিশের দেশভাগের জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। তাদের কাছে আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই - আপনার মতো আমিও কি এই দেশের নাগরিক নই? তাহলে আমার সম্প্রদায় বা আমার জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে কেন?
দেশের চৌকিদার ক্ষমতায় ফিরুক কী না ফিরুক, গোর্খা সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এখনও অনেকটাই অপেক্ষা করতে হবে। শুধুমাত্র ৫৬-ইঞ্চি ছাতি দেখিয়ে আর 'ম্যায় ভি চৌকিদার' বলে মোদী গোর্খাদের সমর্থন আশা করতে পারেন না। সমস্ত ভারতীয়দের সুস্থ জীবনের প্রতিশ্রুতি তাঁকেই দিতে হবে।
একমাত্র তাহলেই, সত্যিকারের 'চৌকিদাররা' হয়ত প্রধানমন্ত্রী রূপের চৌকিদারকে সমর্থন করবে।
কিন্তু তা যতদিন না হচ্ছে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। "আব কি বার, নো চৌকিদার সরকার!"
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে