বাতাস এখনও হিমশীতল: কেন কাশ্মীরী পণ্ডিতরা আর কাশ্মীরে ফিরবেন না

কাশ্মীরী পণ্ডিতদের কাশ্মীরে ফেরানো কেন মিথ্যা প্রচার ছাড়া কিছু নয়

 |  4-minute read |   25-01-2019
  • Total Shares

আজকাল অনেকেই কাশ্মীরে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ফেরানোর কথা বলছেন, সবার শেষে এ কথা বলেছেন শাহ ফয়জল।

আমার মতে, এঁরা সকলেই ভণ্ডের মতো কথা বলছেন।

কাশ্মীরী পণ্ডিতরা আর কোনও দিনই কাশ্মীরে ফিরবেন না। কেন, সেই কারণগুলিই ব্যাখ্যা করছি।

১। তাঁরা সংখ্যালঘু ছিলেন এবং সেটাই থেকে যাবেন

কাশ্মীরের জনসংখ্যার মাত্র চার শতাংশ ছিলেন কাশ্মীরী পণ্ডিতরা, তাঁরা বংশানুক্রমে শত শত বছর ধরে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে এখানে বসবাস করছিলেন। তাঁদের বীভৎস ভাবে কাশ্মীর থেকে তাড়ানো হয়েছিল – অনেককে কচুকাটা করা হয়েছিল। ১৯৯০ সালে যেখানে কাশ্মীরে ৪ লক্ষ পণ্ডিতের বসবাস ছিল, এখন সেখানে বড়জোর কয়েক হাজার পণ্ডিত বসবাস করেন।

কেউ কি হলফ করে বলতে পারবেন যে তাঁরা যদি আবার কাশ্মীরে ফিরে যান তা হলে তাঁদের আর কেউ কচুকাটা করবে না?

kashmiri-pandits-ins_012519090342.jpgধর্ষণ, কচুকাটা করা, হুমকি, লুঠ: কেউ কি হলফ করে বলতে পারেন যে কাশ্মীরী পণ্ডিতরা ফিরলে তাঁদের জীবরন ও সম্ভ্রম রক্ষিত হবে? (ছবি: রয়টার্স)

১৯৯০-এর দশকে তাঁরা যখন কাশ্মীরে বসবাস করতেন তখন মসজিদের লাউডস্পিকার থেকে তাঁদের নামে বিষ-বর্ষণ করা হত এবং তাঁদের বলা হত হয় কাশ্মীর ত্যাগ করতে হবে না হয় ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। তাঁদের বাড়ির দেওয়ালে এই মর্মে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হত এবং লেখা থাকত, হয় কাশ্মীর ছাড়, না হলে হত্যা করা হবে। বাড়ির সামনে দঙ্গল বেঁধে লোকে এসে বলত, পুরুষদের কাশ্মীর ছাড়তে হবে, কিন্তু মহিলাদের কাশ্মীর ছাড়তে দেওয়া হবে না।

শুধুমাত্র শ্রীনগরেই বহু কাশ্মীরী পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়। কোনও গ্রামে এক হাজার মতো পরিবারের মধ্যে হয়তো দশ-পনেরো ঘর কাশ্মীরী পণ্ডিত বসবাস করেন। অভিযোগ কাশ্মীরের মুসলমান তরুণরা মেশিনগান হাতে এসে বেছে বেছে পণ্ডিতদের উপরে গুলি চালাত – কোনও কোনও সময় ওই সব পণ্ডিতদের মুসলমান প্রতিবেশীরাই তাঁদের চিনিয়ে দিত।

অনেক কাশ্মীরী মুসলমানকেই বলতে শোনা যায় যে পণ্ডিতরা কাপুরুষ ছিলেন বলেই তাঁরা কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

এই ধরনের অভিযোগ একেবারেই হাস্যকর।

যদি হাতেগোনা কয়েকজন সংখ্যালঘুকে বেছে বেছে তাদের শিকার বানায় সংখ্যাগুরুরা, তা হলে সেই সব সংখ্যালঘুদের কী করার থাকতে পারে? যখন অসংখ্য কাশ্মীরী পণ্ডিতকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তাঁদের পুরো গোষ্ঠীকেই সন্ত্রস্ত করে ফেলা হচ্ছে, তখন তাঁদের পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে?

জার্মানিতে যে ভাবে নাৎসিরা হত্যা করেছিল ইহুদীদের এটাও সেই রকমই – তফাৎ একটাই, তাঁদের শুধু গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মারা হয়নি।

kashmiri_01201902422_012519090428.jpg তাঁরা তাঁদের ঘরে ফিরতে চেয়েছিলেন। তবে না, তাঁদের জন্য কিছুই আর নেই (বাস্তুচ্যুত কাশ্মীরী হিন্দুদের ছবি, রয়টার্সের তোলা)।

২। না, কোনও ভাবেই কাশ্মীরী মুসলমানরা অনুতপ্ত নয়

অনেক মুসলমানকেই বলতে শোনা যায় যে কাশ্মীরে যা ঘটেছিল সে জন্য দুঃখিত, কারণ কাশ্মীরী পণ্ডিতরা কাশ্মীরেরই অংশ; পণ্ডিতদের ছাড়া কাশ্মীর অসম্পূর্ণ; তারা চায় যে তাঁরা ফিরে আসুন... ইত্যাদি, ইত্যাদি...।

কিন্তু তাঁরা কোনও দিনও এ কথা বলেন না যে কাশ্মীরী মুসলমানরই তাঁদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার জন্য দায়ী, তার বদলে এই ঘটনার জন্য তারা তৎকালীন রাজ্যপাল জগমোহনকে দোষী ঠাওরায়।

এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কী হতে পারে – আর এটাই প্রমাণ করে যে তারা আসলে সত্যিকারের অনুতপ্ত নয়।

অবশ্য তখন যা ঘটেছিল সে জন্য আমি এখনকার কাশ্মীরী তরুণদের দোষারোপ করতে চাই না কারণ যখন সেই ঘটনা ঘটেছিল তখন তখন তো আর তারা ছিল না, বা তারা তখন নিতান্তই শিশু ছিল – তবে যদি তাদের বিবেক বলে থাকে, তা হলে তাদের পূর্বজরা যে মিথ্যা দাবি করে আসছে সেই সব কথাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস না করে জগমোহনকে দোষ না দিযে তাদের পাল্টা কথা বলা উচিত, কিন্তু তাদের যে মিথ্যা বুলি শেখানো হয়েছে তারাও তোতাপাখির মতো সেই বুলি আউড়ে চলেছে।

jagmohan_01201902423_012519090510.jpgপণ্ডিতদের কাশ্মীর-ছাড়া হওয়ার জন্য তৎকালীন রাজ্যপাল জগমোহনকেই দোষারোপ করে মুসলমানরা। এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কী হতে পারে! (ছবি: পিটিআই)

৩। তাঁরা আর কী করতে পারেন?

বর্তমানে কাশ্মীরের বেশিরভাগ নেতাই কাশ্মীরের ‘আজাদি’ চাইছেন, তাদের দাবি বা চাহিদার সঙ্গে ইসলামি মৌলবাদীদের দাবির মিল রয়েছে। তা হলে কী কাশ্মীর ফিরতে হলে ওই পণ্ডিতদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে?

অথবা, তাঁরা কি দ্বিতীয়শ্রেণীর নাগরিক বা ‘ধিম্মি’ হিসাবে প্রত্যাবর্তন করবেন যেখানে ডামোক্লেসের তরবারি সর্বক্ষণ তাঁদের মাথার উপরে ঝুলতে থাকবে আর আবার একবার কচুকাটা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন?

তাঁরা কোথায় থাকবেন এবং কাশ্মীরে তাঁরা কী করবেন? তাঁদের ঘর ঘরবাড়ি হয় ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে, তা না হলে মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে, তাঁদের কাজকর্ম ও ব্যবসাও দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে গেছে।

৪। কাশ্মীরে আর শিকড়টাই নেই

কাশ্মীর থেকে পণ্ডিতদের বিতাড়িত করার পরে সিকি শতক পার হয়ে গেছে।

কাশ্মীরী পণ্ডিতদের তরুণ প্রজন্ম হয় তার পরে জন্মেছে না হয়, যদি তাঁদের আদৌ সেই সব ঘটনার কোনও স্মৃতি থেকে থাকে তা হলে সেই সব স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে।

অর্থাৎ কাশ্মীরে তাঁদের আর কোনও শিকড় নেই। যাঁরা মাঝবয়সী তাঁরাও কোথাও না কোথাও কোনও ভাবে মানিয়ে নিয়েছে নতুন জীবনের সঙ্গে।তাঁরাই বা এখন কাশ্মীরে ফিরে গিয়ে কী করবেন?

তাই কাশ্মীরী পণ্ডিতদের কাশ্মীরে ফেরানো হবে বলে যে আবেগতাড়িত কথাক বলা হয় তা বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছু নয়।

কাশ্মীরী পণ্ডিতদের কাছে কাশ্মীরটা ঝড়ে উড়ে গেছে।

লেখাটি পড়ুন  ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MARKANDEY KATJU MARKANDEY KATJU @mkatju

Former Judge, Supreme Court of India and former Chairman, Press Council of India

Comment