রাজনীতির জগতে 'ইফতার পার্টি' খুবই চালু শব্দবন্ধ, স্বাধীন ভারতে এটি কংগ্রেসের অবদান
ইফতার দিয়েই লোকসভা ভোটের প্রচার শুরু, শহরে ঈদের শুভেচ্ছার ৯৯% হোর্ডিং-তোরণ তৃণমূলের
- Total Shares
ইফতারের সঙ্গে পার্টির যোগাযোগ, মানে ওই রাজনীতির অনুষঙ্গে, কবে থেকে তা শুরু হল, তার ঠিকুজি-কোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমরা তো জানি পুরো রমজান মাস জুড়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকাই রোজা। মানে নিরম্বু উপবাস। এমনকি থুথুও গেলা যাবে না। এমনই কৃচ্ছ্রসাধন। সন্ধ্যার মাগরিবের আজান শুনে জল কিংবা শরবত, খেজুর, তেলেভাজা খেয়ে রোজা ভাঙা। এই রোজাভঙ্গের খাবারকেই ইফতার বলে। মুসলমানদের যা অবশ্য পালনীয় পবিত্র কর্তব্য।
তো যাই হোক, 'ইফতার পার্টি' বেশ কিছুকালই খুবই চালু শব্দবন্ধ। বিশেষ করে রাজনীতির জগতে। স্বাধীন ভারতে এ কংগ্রেসের অবদান। অন্তত বিশেষজ্ঞরা তাই মনে করেন। জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রথা চালু করেন। তবে, রাজনীতিজ্ঞদের মতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নয়, ব্যক্তি নেহরু ইফতারে আমন্ত্রণ জানাতেন খুবই ঘনিষ্ঠ মুসলমান ও হিন্দু বন্ধুদের। নেহরুর কাছে এ ছিল আন্তঃধর্মীয় পারস্পরিক মতবিনিময়ের একটি পরিবেশ তৈরি করা, জাতীয় সংহতির জরুরি প্রয়োজনে সংখ্যালঘুদের কাছে পৌঁছানো। এই ইফতারের আয়োজন হত সাধারণ ভাবে জাতীয় কংগ্রেসের সদর দফতরে। প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আমলে অবশ্য এ পাট উঠে যায়। ফের রীতিমতো ঘটা করে চালু হয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে।
ইন্দিরার ইফতারের আয়োজন ছিল দেখার মতো, একেবারে পাঁচতারা আয়োজন
সমসাময়িক লোকজন বলেন, ইন্দিরার ইফতারের আয়োজন ছিল দেখার মতো। একেবারে পাঁচতারা আয়োজন। সমালোচকদের মতে, এই আয়োজনে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত হতেন সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও সামাজিক নেতারা। যাঁদের হয়তো কোনও রাজনৈতিক প্রতাপ কিংবা ক্ষমতা নেই, কিন্তু মুসলিম সমাজের মানুষদের উপর নানা ধর্মীয়, সামাজিক বিষয়ে ফতোয়া জারি করার ক্ষমতা আছে। এ সময় কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলোতেও এই ইফতার রাজনীতির প্রভাব বাড়ে। ক্রমে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেও এই ইফতার পার্টির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম বিজেপি ও বামপন্থী দলগুলি। তবে, বামপন্থী নেতা-কর্মীরা ইফতারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন না তা নয়। বিজেপি অবশ্য এর মধ্যে 'মুসলিম তোষণ' খুঁজে পায়। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অটলবিহারী বাজপেয়ী অবশ্য ইফতারের রাজনৈতিক ট্র্যাসডিশন বজায় রেখেছিলেন। মনমোহন সিংহের আমলেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
বিজেপি অবশ্য ইফতার আয়োজনে খুব বেশি উৎসাহী নয়
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইফতার তো দূরের কথা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যে কোনও উৎসব থেকে দল ও সরকারকে দূরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এমনকি উৎসবের নির্দিষ্ট দিনে অন্যান্য সরকারি কর্মসূচি পালনেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ আগ্রহ। এবার বাধ্য হয়েই নীতি-আয়োগের বৈঠকের দিন পেছোতে হল। ঈদের দিনেই এই বৈঠকের দিন স্থির করায় একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা আপত্তি করেন। এ বছরই প্রথম রাষ্ট্রপতি ভবন থেকেও জানিয়ে দেওয়া হল, 'ইফতার পার্টি' হবে না। কেননা বর্তমান রাষ্ট্রপতি মনে করেন, 'জনগণের করের টাকায়, সরকারি ভবনে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা সেকুলার আদর্শের পরিপন্থী।' সমালোচকরা অবশ্য ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তাঁদের ইঙ্গিত, দেওয়ালির সময় রাষ্ট্রপতি ভবন আলোয় মালায় সাজানোর দিকে।
সামনে ২০১৯, লোকসভা নির্বাচন। 'ইফতার পার্টি'র উত্তাপ যেন একটু বেশিই মনে হচ্ছে। ঘরের দিকে তাকালে দেখতে পাব বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, চিৎপুর, বেকবাগান, পার্কসার্কাস, মেটিয়াবুরুজে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো বিশাল বিশাল হোর্ডিং ও তোরণের ছড়াছড়ি। সবই রাজনৈতিক দলের। যার ৯৯ শতাংশ তৃণমূল কংগ্রেসের।
ইফতার আয়োজনে পিছিয়ে নেই তৃণমূলও
কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে রাহুল গান্ধী এই প্রথম ইফতারের আয়োজন করেছেন। সোনিয়াও কংগ্রেসের ট্র্যাডিশন ভাঙেননি। ব্যতিক্রম ২০১৬ ও ২০১৭, এই দু-বছর ইফতারের আয়োজন করেনি কংগ্রেস। এবার অবশ্য দিল্লির এক বড় হোটেলে বেশ এলাহি আয়োজনের খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। এই ইফতার পার্টি যে রীতিমতো রাজনৈতিক সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। রাখঢাক-গুড়গুড়ও নেই।
আমন্ত্রিত ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি। কেন্দ্রের বিরোধী জোটের বেশ কয়েকজন চেনা নেতা ছিলেন, ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধিও। খুশির ঈদেই মধ্যেই লোকসভা নির্বাচনের ঢাক বেজে গেল।