২০১৯ সালের ভোটে মহাজোট জয়ী হলে তা দেশের পক্ষে কেন মঙ্গল
একবার প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ পেয়েও কী ভাবে তা নষ্ট করলেন নরেন্দ্র মোদী
- Total Shares
কংগ্রেস পরিচালিত মহাজোট সরকার, যেখানে নানাবিধ রঙীন চরিত্র রয়েছে, তারা লজ্জা দেওয়ার জন্য একটি ছোটখাট নাটিকা উপস্থাপনা করতে চলছে, তবে এটি প্রকৃতপক্ষে দেশের পক্ষে ভালোই হবে – যদিও তার মেয়াদ তেজস্ক্রিয় থোরিয়ামের হাফ-লাইফের মতো অত দীর্ঘ নয়।
নতুন বছরে এএনআই-কে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে ২০১৯ সালের নির্বাচনকে জনতা ও জোটের মধ্যে লড়াই বলে বর্ণনা করেছেন। এটা অত্যন্ত বিচক্ষণ নীতি। এই লড়াই কখনোই মোদী বনাম বিরোধী নয়, বরং একদিকে মোদী ও জনতা এবং বিপরীতে বিরোধীরা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বুঝতে পেরেছেন যে গ্রামীণ দুরবস্থা মহাজোটের দিকে পাল্লা ভারী করতে পারে। (ছবি: এএনআই)
মহাজোট, মানে হিন্দিতে যাকে মহাগটবন্ধন বলা হচ্ছে, তাকে একেবারে খারিজ করে দিয়ে মোদী বলেছেন, “এখনও ওঁরা অন্য সুরে কথা বলছেন। এই জনতা কারা? তাঁরা আসলে নিজেদের বাঁচাতে তাঁরা একে অপরের সাহায্য প্রার্থনা করছেন।”
যাই হোক, এই সাক্ষাৎকারে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে মোদী বুঝতে পারছেন গ্রামীণ দুরবস্থার জন্য মহাজোটের পালে হাওয়া লাগতে পারে। সেই কারণেই তিনি তাঁর সভায় অর্থনৈতিক কথাবার্তার বদলে অনেক বেশি করে উঠে আসছে হিন্দুত্ব এবং রামমন্দিরের কথা।
গান্ধী পরিবারকে (তথা কথিত ফার্স্ট ফ্যামিলি এবং এখন ওঁরা জামিনে মুক্ত) আক্রমণও চলতে থাকবে।
তবে তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমা ও জাদুর উল্টোপথে হেঁটে প্রচার করা মোদীর পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ হবে না। কড়া হিন্দুত্ব থেকে তাঁর সরে যাওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া তাঁর কাছে এক অর্থে পরাজয়েরই সামিল। আবার অর্থনৈতিক বিষয়ের উপরে নজর দিলে ভোটের ঢেউ তাঁর অনুকূলে আসবে না। সকলকে খুশি করতে গিয়ে মোদী এখন দু'নৌকার মাঝে পড়তে পারেন। ওই সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, সেই দুর্ভাগ্য এড়াতে হলে তাঁকে তাঁর প্রাথমিক ভাবনা থেকে দু'কদম পিছিয়ে যেতে হবে: মোদী এবং জনতা এবং অ-বিজেপি মহাজোট। এটাই তাঁর সমস্যা সমাধানের আশু উপায় হতে পারে।
২০১৯ সালের মে মাসে সরকার গড়তে গেলে বিরোধী জোটকে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমে কংগ্রেস – এই দলের নেতারাই বলেছেন যে যদি রাহুল গান্ধীকেই মহাজোটের নেতৃত্বে থাকতে হয় তা হলে অন্তত ১২৫টি আসন জিততে হবে এবং সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় লোকসভায় ২৭২ আসনের যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেখানে তারা ৪৪টি আসন পেয়েছিল সেখান থেকে এই জায়গায় পৌঁছানো যথেষ্ট কঠিন ব্যাপার, সে ক্ষেত্রে দেখে নিতে হবে কোন রাজ্য থেকে তাদের কত আসন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিজেপির বিরোধী শক্তি যারা রয়েছে তারা ২০১৯ সালে যদি ভালোভাবে সরকার গড়তে পারে, তা হলে ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সরকার হবে (সূত্র: পিটিআই)
দ্বিতীয় প্রাথমিক শর্তটি আরও কৌশলী – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, কে চন্দ্রশেখর রাও ও নবীন পট্টনায়কের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিরোধী নেতানেত্রীদের আয়ত্তে নিয়ে আসা। এই পাঁচটি রাজনৈতিক দলের হাতে ২০১৯ সালের নির্বাচনের পরে সব মিলিয়ে মোটামুটি ১০০টি মতো লোকসভা আসন থাকবে।
ইউপিএ পরিচালিত মহাজোটের সরকারের ব্যাপারে এই সব দলগুলোকে রাজি করাতে হবে রাহুল গান্ধীকে এবং তা করতে হবে ফেডেরাল ফ্রন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই।
তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসানোর জন্য অন্য দলগুলিকে রাজি করানো রাহুল গান্ধীর পক্ষে সহজ হবে না। (সূত্র: পিটিআই)
এখন একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক ১২৫টি লোকসভা আসন কী ভাবে পেতে পারে কংগ্রেস। প্রথমে দেশকে ছ'টি ভাগে ভাগ করে নেওয়া যাক: উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, মধ্য এবং উত্তরপূর্ব ভারত।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে যেখানে কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে তার সেরা ছবিটি এখানে তুলে ধরা হল। উত্তরপূর্বাঞ্চলে প্রচার শুরু হয়ে গেছে, ২০১৯ সালের মে মাসের মধ্যে অনেক পরিবর্তন হতে পারে।
উত্তরাঞ্চল: উত্তরপ্রদেশ (২), বিহার (১), দিল্লি (২), হরিয়ানা (৪), হিমাচলপ্রদেশ (২), উত্তরাখণ্ড (১), জম্মু-কাশ্মীর (২), পঞ্জাব (৭)। মোট: ২১
পশ্চিমাঞ্চল: মহারাষ্ট্র (৫), গুজরাট (৪), রাজস্থান (৭), গোয়া (১) মোট: ১৭।
দক্ষিণ ভারত: কর্নাটক (১২), অন্ধ্রপ্রদেশ (২), তেলঙ্গনা (৩), কেরল (৮), তামিলনাড়ু (৩)। মোট: ২৮।
পূর্বাঞ্চল: পশ্চিমবঙ্গ (২), ওড়িশা (০), ঝাড়খণ্ড (৫)। মোট: ৭।
মধ্যাঞ্চল: মধ্যপ্রদেশ (৮), ছত্তিশগড় (৭)। মোট: ১৫
উত্তরপূর্বাঞ্চল: অসম (২), মণিপুর (১), মেঘালয় (০), ত্রিপুরা (০), নাগাল্যান্ড (০), অরুণাচলপ্রদেশ (১), মিজোরাম (০), সিকিম (০)। মোট: ৪।
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল: পুদুচেরি (১), চণ্ডীগড় (১), লাক্ষাদ্বীপ (১), আন্দামান ও নিকোবর (০), দাদরা ও নগর হাভেলি (০), দমন ও দিউ (০)। মোট: ৩।
অর্থাৎ খুব ভালো ফল করলে সব মিলিয়ে কংগ্রেস পেতে পারে উত্তরাঞ্চল (২১), পশ্চিমাঞ্চল (১৭), দক্ষিণাঞ্চল (২৮), পূর্বাঞ্চল (৭), মধ্যাঞ্চল (১৫), উত্তরপূর্বাঞ্চল (৪) ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (৩) মিলিয়ে মোট ৯৫টি আসন।
এই সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস যে ফল করেছে তার ভিত্তিতে এই হাসাব কষা হয়েছে। তার সঙ্গে পাঁচ রাজ্যে, বিশেষ করে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্তানে সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস যে ফল করেছে তাও বিবেচনা করা হয়েছে। সংসদের নির্বাচন ও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের ধরনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য পুরোদমে প্রচার খুব শীঘ্রই শুরু হয়ে যাবে, তখন রসায়ন বদলে যাবে গণিতে।
- এ ব্যাপারে তাই কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া খুবই কঠিন – লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের পক্ষে ১০০ আসন পার করা মুশকিল হবে, সেক্ষেত্রে মহাজোট গড়ে সেই জোটে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরার জন্য কংগ্রেস যে মনে করছে তাদের অন্তত ১২৫টি আসন দরকার, তা থেকে তাদের আসনসংখ্যা অনেকটাই কম থাকছে।
এই পরিস্থিতিতে ২৭২ সংখ্যায় পৌঁছাতে হলে কংগ্রেসের দরকার হবে আরও মোটামুটি ১৮০টি আসন। সে ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নিয়ে মমতা ও মায়াবতীর চাপের মুখে পড়তে পারে কংগ্রেস এবং সে ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত ভাবে সামনে চলে আসতে পারেন কে চন্দ্রশেখর রাও।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না যে কংগ্রেস ১০০টির বোশি আসন পাবে না (সূত্র: রয়টার্স)
- যদি বিজেপি ২০০টির চেয়ে কম আসন পায় ত্রিশঙ্কু লোকসভা হতে পারে।
ডিএমকে বেশি আসন পেলে তাকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ ১৩০টি মতো আসন পেয়েই থমকে যাবে।
সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস, তেলঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতি ও অন্য আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে গঠিত ফেডেরাল ফ্রন্ট সেক্ষেত্রে ইউপিএ-তে যোগ দিতে পারে আবার নাও পারে। যদি তারা ইউপিএ-তে যোগ দেয় তা হলে কি তারা রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নেবে? আঞ্চলিক দলগুলির তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও তারা মেনে নিতে পারে। কারণ কাঁকড়ার মতো মায়াবতী-অখিলেশ-মমতা চেষ্টা করবেন একে অন্যের উত্থান আটকে দিতে। উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাঁরা যত সংখ্যক আসন পাবেন তা নিয়ে তাঁরা অবশ্য সরকার গড়ার মতো দরকষাকষি করতে পারবেন না।
এক মাস আগেও পিছনের সারিতে বসে মহাজোটে পরিচালনা করে ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় তাঁর মানসিকতা বদলে দিয়েছে। ২০১৯ সালেই যখন সম্ভাবনা রয়েছে তখন ২০২৪ সাল পর্যন্ত কেন তিনি অপেক্ষা করবেন?
তবে মাত্র ৯৫টি আসন নিয়ে যখন নিজের ভাঁড়ারই সমস্যাসঙ্কুল হয়ে থাকবে, বিশেষ করে আঞ্চলিক নেতাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও মেজাজের উপরে নির্ভর করে চলতে হবে, যে কোনও সময় তারা সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে।
২০১৯ সালের নির্বাচনের ফল যখন প্রকাশিত হবে তখন নরেন্দ্র মোদীকে বিরোধী আসনে বসতে হতে পারে। (সূত্র: টুইটার)
আর নরেন্দ্র মোদী? ১৮০ জন মতো সাংসদকে নিয়ে বিরোধী আসনে বসা ভাবনার বিষয়। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে ১০০টি আসন কমে যাওয়া মোটেই সুখকর ব্যাপার নয়। ২০১৪ সালের আগে ছোট সরকার ভালো প্রশাসনের (maximum governance, minimum government) যে অঙ্গীকার তিনি করেছিলেন তা পূরণ না করতে পারার জন্য তিনি কেবলমাত্র নিজেকেই দুষতেই পারেন।
কোনও দলই ১০০টি আসন না পাওয়া সত্ত্বেও মহাজোট যদি সরকার গড়ে তা হলে তাঁর মেজাজ আরও ফুরফুরে হয়ে যাবে।
কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মহাজোট আসলে একটি তাসের ঘর হতে চলেছে তাই জোটের অভ্যন্তরে যথেষ্ট মতানৈক্য থাকবে।
তা সত্ত্বেও ভারতের নির্বাচকরা একটি বিকল্প সরকার পাবেন এবং সেই সরকারের আর্থিক, বিদেশ ও সামাজিক নীতির দিকটি দেখতে পাবেন।
মোদীর চিন্তা একটাই – তাঁরা যেটা পাচ্ছেন যদি তাতেই খুশি হন নির্বাচকরা। সে ক্ষেত্রে রাজীব গান্ধী যে ভাবে তাঁর একবারের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ করেছিলেন, সেই ভাবেই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ করতে পারেন নরেন্দ্র মোদী।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে