সাধারণ নির্বাচন ২০১৯: বালাকোটের পরেও ক্ষমতা দখল নিয়ে নিশ্চিত নয় বিজেপি নেতৃত্ব
২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের ছ'মাস আগে বাজপেয়ী সরকারের কী অবস্থা হয়েছিল তা এখনও স্মৃতিতে রয়েছে
- Total Shares
গত শুক্রবারের (মার্চ ৮) বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা সরকারকে এখনই মুলতবি করা হচ্ছে না। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে, এই দুটি বিজেপি শাসিত রাজ্যে এক সঙ্গে দুটি করে নির্বাচন হওয়া নিয়ে যে জল্পনা শুরু হয়েছিল সেই জল্পনারও অবসান ঘটল।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটা খুবই ভালো একটি সঙ্কেত। এই সিদ্ধান্ত থেকে একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার - বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে বিজেপি যতই বড় বড় দাবি করে থাকুক না কেন, বিজেপি নেতৃত্ব কিন্তু পুনরায় ক্ষমতা দখল করার বিষয়ে নিশ্চিত নয়।
বিভিন্ন স্তরের বিজেপি নেতৃত্বই বহু দিন ধরেই তিনটি রাজ্যে একসঙ্গে বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি জানিয়ে আসছিল। তৃতীয় রাজ্যটি হচ্ছে ঝাড়খণ্ড। এ বছর নভেম্বর মাসে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। অন্যদিকে, ঝাড়খণ্ড বিধানসভার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের জানুয়ারী মাসে। এই তিনটে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আনার পিছনে একটি যুক্তি রয়েছে - বিজেপি ভেবেছিল, লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারলে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা ও মোদী সরকারের সাফল্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে তারা বিধানসভা নির্বাচনেও জয়লাভ করতে পারবে। সত্যি কথা বলতে, ঝাড়খণ্ড সরকার এই যুক্তিটা সকলের আগেই বুঝতে পেরেছিল।
বালাকোট হামলার সরকারি দাবি অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে [ছবি: রয়টার্স]
কিন্তু একটা কথা বুঝতে আমাদের কোনও অসুবিধা হয় না - কেন এই তিনটি রাজ্যকে মোদীর জনপ্রিয়তা ও বালাকোট-পরবর্তী পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে হচ্ছে?
তবে, প্রত্যাঘাতের পর রাজনৈতিকভাবে যে সুবিধাগুলো তুলতে পারবে বলে ভেবেছিল বিজেপি, সেই সুযোগ সুবিধাগুলো ইতিমধ্যেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলো নয়, শহীদ সিআরপিএফ জওয়ানদের কিছু পরিবারও বালাকোট হামলার প্রমান দাবি করেছে; আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জৈশ-ই-মহম্মদের জঙ্গিঘাঁটি গুড়িয়ে দেওয়া ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে পরাস্ত করার প্রমান দাবি করেছে। বিজেপি মন্ত্রী ও নেতারা এয়ার স্ট্রাইকে ২৫০ থেকে ৪০০ জন জঙ্গির মৃত্যুর কথা কিংবা পাকিস্তানকে 'শিক্ষা' দেওয়ার কথা দাবি করছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সেই দাবি অনেকটাই ফিকে বলে মনে হচ্ছে। যদি কিছু সত্য থেকে থাকে তা হল - ভারতের মিগ-২১ ভেঙে পড়েছিল এবং সেই বিমানটির পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানের হাতে বন্দি হয়েছিলেন এবং পড়ে মুক্তি পেয়েছিলেন।
বিজেপি যে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে বলে ভেবেছিল সেই সুযোগ সুবিধা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে [ছবি: রয়টার্স]
পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে রাফাল চুক্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর বিষয় এবার প্রকাশ্যে এসেছে। সপ্তাহের শুরুতে সরকারের শীর্ষ স্থানীয় আইন বিষয়ক আধিকারিক কে কে বেণুগোপাল সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছেন, রাফাল চুক্তি সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে 'চুরি' হয়ে গিয়েছে। এর ফলে ভোটারদের কাছে একটা বার্তাই গেল - রাফাল চুক্তি প্রক্রিয়ায় নিশ্চয়ই কোনও না কোনও গন্ডগোল রয়েছে।
মোদী সরকার ভেবেছিল যে বালাকোট এয়ার স্ট্রাইকের পর জনতা পুরোনো ইস্যুগুলো ভুলে যাবে। কিন্তু তা যে হয়নি তা ইন্ডিয়া টুডের সমীক্ষা থেকেই পরিষ্কার। এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে বেকারত্ব ইস্যু এখনও ভোটারদের কাছে সবচাইতে বেশি (৩৬ শতাংশ) প্রাধান্য পাচ্ছে। সিএসডিএস যে তিনটি সমীক্ষা করেছে (শেষে সমীক্ষাটি হয়েছিল মে ২০১৮) তাতে দেখা যাচ্ছে যে ৫৭ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে যে গত চার বছরে নিজেদের এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
এর পর পরই আরও বেশ কয়েকটি খারাপ খবর এসেছে। ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিসের সমীক্ষায় বলা হয়েছে চার দশকে দেশে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে। ১৭-১৮ আর্থিক বছরে দেশের বেকারত্বের হার ৬.১ শতাংশ। এর পর সিএমআইই একটি রিপোর্টে আবার জানিয়েছে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দেশের শ্রমিক শক্তি প্রায় ২৫.৭ মিলিয়ন হ্রাস পেয়েছে এবং এই সময়তেই কর্মসংস্থানের পরিমান ১৮.৩ মিলিয়ন কমে গিয়েছে।
ইন্ডিয়া টুডের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভোটারদের প্রাধান্যের তালিকায় সন্ত্রাসবাদ ইস্যু দু'নম্বরে (২৩ শতাংশ) রয়েছে। তিন নম্বরে রয়েছে কৃষি সমস্যা (২২ শতাংশ)।
পুলওয়ামা জঙ্গি হামলার পর সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটি ওপরের দিকে উঠে এসেছে। তবে এর প্রভাব কার্গিল যুদ্ধের পর ১৯৯৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে যতটা পড়েছিল ততটা এবারে পড়বে না।
আর, তাই খুব সম্ভবত, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভা মুলতবি করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হল।
বেকারত্ব সমস্যা চিন্তায় রাখবে বিজেপিকে [ছবি: পিটিআই]
কৃষি সমস্যা এখনও বেশ বড় সমস্যা। মোদী কৃষকদের বার্ষিক ছ'হাজার টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করার পরেও। জিএসটি নিয়ে ব্যবসায়ীরা ক্রুদ্ধ। দলিত, মুসলমান ও আদিবাসীরা হিন্দুত্ববাদীদের উপর অসন্তুষ্ট। এই বিষয়গুলো কিন্তু মোদী সরকারকে চিন্তায় রাখবে। সিএসডিএস-এর সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে মোদী সরকারের উপর অসন্তোষের হার মে ২০১৭ তে ২৭ শতাংশ ছিল, যা জানুয়ারি ২০১৮তে বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে এবং মে ২০১৮তে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। জুলাই ২০১৩তে মনমোহন সিং সরকারের আমলে অসন্তোষের হার (৩৭ শতাংশ) যতটা যা ছিল তার চাইতে মোদীর আমলের অসন্তোষ অনেকটাই বেশি।
বিজেপি শাসিত দুই রাজ্য - মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানাতে - বিজেপি এখন খুব ভাবনা চিন্তা করে স্ট্রাটেজি ঠিক করতে চাইছে। তা করার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। ২০০৪ সাধারণ নির্বাচনের ছ'মাস আগে অটল বিহারি বাজপেয়ী সরকারের কী অবস্থা হয়েছিল তা এখনও সকলেরই স্মরণে রয়েছে। সেই সময়েও বিজেপি ভেবেছিল যে বাজপেয়ীর জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে - রাজস্থান, মধ্যেপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে - সহজেই জয়লাভ করা সম্ভব হবে। এই ভ্রান্ত ধারণার উপর ভর করে ডিসেম্বর ২০০৩-এ এই তিনটি রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হয়েছিল।
এখন - মোদী যদি হেরে যায়, সেই ভয়ে - মোদীর উপর ভরসা করে আর নিজেদের বিপদ ডাকতে চাইছে না তিনটি রাজ্য।
আর, মোদী সরকার যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে এই তিনটি রাজ্যে বিজেপির পুনরায় ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
তাদের আর হারাবার কিছু থাকবে না।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে