প্রতি পাঁচজনে একজন বাঙালি বাংলার বাইরে, কেন?
স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর চাকরির সুযোগ নেই, তাই বাংলা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে এত লোক
- Total Shares
কলকাতায় তিনটি সমস্যা রয়েছে। এখানে যথেষ্ট সংখ্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, শিক্ষান্তে চাকরির সুযোগ নেই আর অসুস্থ হলে ঠিকমতো চিকিৎসার সুযোগ নেই। কলকাতায় চিকিৎসকরা তো রোগীদের মানুষ বলে মনেই করেন না!
আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বাড়ি খড়্গপুরে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি কলকাতায়, পরে চাকরি করেছি বেঙ্গালুরুতে, এখন মেলবোর্নে। আমি একাধিক শহরের সুযোগ-সুবিধা ও কর্মসংস্কৃতি কেমন তা দেখেছি। চাকরি দিয়েই শুরু করি। আমি নিজে সফটওয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার বলে মূলত এই ক্ষেত্রের কথাই বলব।
কলকাতায় কাজের পরিবেশই নেই (ছবিটি উপস্থাপনার জন্য)
কলকাতায় সরকারি চাকরি নেই। বেসরকারি চাকরিই বা কোথায়? কলকাতায় হাতে গোনা দু-তিনটি বড় সংস্থা আছে। প্রতিটি সংস্থাই বাবু কালচারে জর্জরিত। ধরা যাক একজন জুনিয়রের কথা। তিনি সকাল ন’টায় অফিসে ঢোকেন। তাঁর যিনি ম্যানেজার তিনি ঢুকলেন সাড়ে ১১টা-১২টায়, চা-প্রভৃতি খেয়ে কথাবার্তা বলে দেখা গেল দেড়টা বাজে! এ বার লাঞ্চ, চারটেয় আরেক বার চা। এর উপরে তিনি ধূমপায়ী হলে তো কথাই নেই!
সাড়ে ছটা নাগাদ যখন তাঁর কাজের মর্জি হল, তখন কাজ শেষ করে জুনিয়রের বাড়ি ফেরার সময়। এবার ম্যানেজার বললেন, “সবে তো সাড়ে ছ’টা, এর মধ্যেই বাড়ি!” ম্যানেজার চান রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরতে। তাতে অফিসেও প্রচুর কাজ দেখানো হল, আবার রাতে ফ্রি ক্যাবে বাড়িও ফেরা হল। সারা দিন কাজ করে যাওয়া জুনিয়রের ব্যক্তিজীবন বলে কিছু আর রইল না।
জুনিয়রকে কাজ শিখতে দেওয়া হয় না, ভালো প্রজক্ট দেওয়া হয় না, যাতে ভালো কাজ শিখে কেউ সংস্থা বদল করতে না পারে। কেউ ভালো কাজ করলে বা সিনিয়রের চেয়ে বেশি জেনে ফেললে সিনিয়রের ইগো-সমস্যা শুরু হয়ে যায়। কাজ পারুন বা না পারুন, তিনি সিনিয়র, তাই তিনি ভুল বলুন বা ঠিক বলুন তাঁর কথাই মেনে চলতে হবে।
কলকাতা আধুনিক হলেও এখন পুরোনো বাবু-কালচার হয়েই গেছে (সুবীর হালদার)
এই শহরে লোকজন জানে, কোনও কারণে যার কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই, সেই এই শহরে কাজ করছে। তাই এক কোম্পানি ছেড়ে অন্য কোম্পানি গেলে সেখানেও এই একই ধরনের বাবু কালচার। অন্য শহরে এই ধরনের বাবু-সংস্কৃতি দেখা যায় না। সেখানে কাজ শেখানো হয়। কেউ রাত পর্যন্ত অফিসে থাকলে তিনি কাজের জন্যই থাকেন, সময় নষ্ট করার জন্য নয়।
হতে পারে কলকাতায় এই জন্য ভালো প্রকল্প বা প্রজেক্ট আসে না। তাই এখানে উন্নতিও নেই। বাড়ির টানে শহরে থাকলে, একটি সংস্থা ছে়ড়ে অন্য সংস্থায় যাও, সেখানেও ওই একই অবস্থায় পড়তে হবে। কেউ যদি বালুরঘাট থেকে কলকাতায় এসে থাকেন এবং মনে ভাবেন সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ি যাবেন, তা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। দেখা যাবে বছরে হয়তো দু-বার ছুটি পাচ্ছেন। তা হলে তিনি বেঙ্গালুরুতে যাবেন না কেন? সেখানে চাকরির অনেক সুযোগ। জীবনে উন্নতি করারও অনেক সুযোগ। সিনিয়র-জুনিয়র ভেদাভেদ ও বাবু কালচার নেই।
আমার বাড়ি খড়্গপুরে ছিল, তাই কলকাতা থেকে মাঝেমধ্যে বাড়িতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু উত্তরবঙ্গের যে ছাত্র সরকারি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুযোগ পেলেন না, বেসরকারি কলেজে পড়তে চান, তিনি যদি কলকাতায় না এসে দিল্লি-বেঙ্গালুরুতে যান, পড়া শেষে চাকরির অনেক বেশি সুযোগ পাবেন। এ রাজ্যে যে ক’টা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলি সবই কলকাতায়। মুর্শিদাবাদের বা রায়গঞ্জের ছাত্র ভালো স্কুল-কলেজ কোথায় পাবেন?
মিটিং-মিছিল এই রাজ্যের বড় সমস্যা (ফাইল চিত্র)
মিটিং-মিছিল ধর্মঘট প্রভৃতি তো এই শহরের নিত্য দিনের ঘটনা। এর ফলে লোকের যে কত সমস্যা হয়, সময় নষ্ট হয়, অ্যাম্বুল্যান্সে রোগী আটকে পড়েন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কার্যত বন্ধ হয়ে যায়... যাঁরা রাজ্যের বাসিন্দা তাঁরা ভালো করেই এ কথা জানেন। শিক্ষা এবং চাকরির জন্য যাঁরা বাংলার বাইরে গেছেন, থেকেছেন তাঁরা বুঝতে পারেন চিকিসায় পার্থক্যটা ঠিক কোথায়। পশ্চিমবঙ্গে, মানে কলকাতায় তিন-চারটে নামী বেসরকারি হাসপাতাল আছে বটে, কিন্তু সেখানে খরচ কতটা আর পরিষেবা কেমন সে কথা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। পশ্চিমবঙ্গে কি সত্যিই উন্নত মানের চিকিৎসার সুযোগ আছে? ডাক্তাররা তো রোগীগের মানুষ বলে মনেই করেন না! কী রোগ হয়েছে বলেন না, কতদিনে ওষুধের ফল পাওয়া যাবে, তিনদিন না দশদিন তাও বলেন না। একটা ওষুধ লিখে দিলেই কাজ শেষ।
কিন্তু রাজ্যের বাইরে যান, সেখানে রোগীর কথা ডাক্তাররা মন দিয়ে শোনেন। তাঁরা বলে দেন কোন ওষুধ কেন দিচ্ছেন এবং কত দিনে কাজ হওয়া শুরু হবে। এখানে ডাক্তারদের থেকে খারাপ ব্যবহার পেতে পেতে এমন হয়ে গেছে যে রোগী ও তাঁদের পরিবারের লোকজন জানেনই না তাঁদের আসলে কেমন ব্যবহার পাওয়া উচিৎ ডাক্তারদের থেকে। এখানে ডাক্তার-রোগীর অনুপাতও এমন যে ডাক্তার তো রোগীকে দেখেনই না।
আর রাজ্য ছেড়ে বাইরে যাবেন? শুনবেন কোন রাজনৈতিক দলের দাদা এসে আপনার ঘর দখল করে নিয়েছে। ভাড়াটে রাখলে উঠতে চাইবে না। তাই পাকাপাকি ভাবেই চলে যেতে হবে। যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে আছেন, আমার মনে হয় নিরুপায় হয়েই আছেন।