মৌসুনি দ্বীপ: ভাটির টানে বারো মাস, বাঁধের ধারে যাদের বাস
বাঁধের ধারে যাদের বাস, তাঁদের জীবনের খেলাঘরের কথা, সঙ্গে কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের ছবি
- Total Shares
“আপনাদের এখানে দূষণের মাত্রা বেশি, তাই আকাশের তারা দেখা যায় না, এত শব্দ যে রাতেও জোরে কথা বলতে হয়। আমাদের গ্রামে নদীর ওপারের শব্দও শোনা যায়।... তবুও আমাদের সবচেয়ে ভালো লেগেছে বিড়লা তারামণ্ডল। আমাদের গ্রামে এত কাছ থেকে তো আকাশ দেখা যায় না।”
“আমাদের দ্বীপ থেকে সূর্যাস্ত খুব সুন্দর দেখায়, প্রায়ই দেখি। তাও দেখতে ভালো লাগে।”
মৌসুনি দ্বীপ থেকে ওরা কলকাতায় এসেছে। সেই দ্বীপ যার একাংশে জোয়ার-ভাটা খেলে আর বর্ষার কোটালের সময় গ্রাম আর নদীর সঙ্গে তফাৎ করা যায় না। তার মধ্যেই বাস করে। তবে এখন অনেক 'সুবিধা' হয়েছে। ফ্লাড সেন্টারে চলে যায় দিন কুড়ির জন্য। সঙ্গে গোরু-ছাগলও নিয়ে যায়, তাদের বন্দোবস্ত রয়েছে সেখানে। জল নামলে চলে আসে। মুশকিল হল, নোনা জল বেশি দূর পর্যন্ত ঢুকলে। তখন আর সেই জমিতে চাষ করা যায় না, অন্তত চার-পাঁচ বছর। বর্ষায় মাটির বাড়িগুলো ভেঙে যায়।
বর্ষায় ভেঙে পড়ে মাটির বাড়িগুলো। (ছবি: কৌশিক চট্টোপাধ্যায়)
কথাগুলো ওরাই বলছিল, সকলেই মৌসুনি কোঅপারেটিভ হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী, বেশ স্মার্ট, গুছিয়ে কথা বলে। চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
“আচ্ছা, তোমাদের স্কুলে তো অনেক ছাত্রছাত্রী, তা তোমাদের এই এগারো জনকেই কলকাতায় নিয়ে আসা হল কেন?”
“আমরা গরিব আর মেধাবী বলে।”
চটপট উত্তর দিল সুতৃষ্ণা রায়। নবম শ্রেণীতে পড়ে, ওই স্কুলেই।
ওরা যে মেধাবী তার প্রমাণ তো কথাবার্তাতেই পেয়েছি। তাই জিজ্ঞাসা করলাম, “কী করে বুঝলে যে গরিব?”
চটপট উত্তর, “সে আমরা আশপাশের সব দেখলেই বুঝতে পারি। ওর বাড়িতে টিভি আছে, কিন্তু টিউশন পড়তে যায় বলে দেখতে পারে না, আমি টিউশন পড়তে যাই না, কিন্তু বাড়িতে টিভি নেই। আমার পড়তে ভালো লাগে।”
নদীর স্রোতের বিপরীতে জীবনটাই শুধু ভেসে থাকে, ভেসে যায় বই-খাতা-কলম। ফের নতুন করে শুরু করতে হয়। পড়তে ভালোবাসে বলেই বারে বারে নতুন করে শুরু করে ওরা। ওদের জীবন মানে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের ছবিগুলো ছিল ভাটির দেশ বারো মাস, বাঁধের ধারে যাদের বাস প্রদর্শনীর অঙ্গ।
জল সরেছে, তাই চলছে বই শুকনো করার পালা। (ছবি: কৌশিক চট্টোপাধ্যায়)
দুধকুমার মণ্ডল এ বছর দশম শ্রেণীতে, বেশ গুছিয়েই বলল, “মেন রোডটা বাঁধের মতো কাজ করে, তবে আমাদের পশ্চিমে রয়েছে বড়তলা নদী আর দক্ষিণে চিনাই।...আমাদের গ্রামের বেশিরভাগই কৃষিজীবী, কেউ ব্যবসা বা চাকরি করেন। ব্যবসা মানে মুদির দোকান, শব্জি বিক্রি – এই সব, চাকরি মানে ওই সব দোকানে কাজ করা। বালিতলার দিকে ফিশারিজ আছে, সেখানে মৎস্যচাষ হয়।”
আমাদের গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, আমি নিজের শিকড়ও গ্রামে। কিন্তু গ্রামের ভূগোল ও আর্থসামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে এমন ব্যুৎপত্তি দেখিনি অন্তত আমাদের গ্রামে যাদের সঙ্গে মিশেছি, পড়িয়েছি তাদের।
অমৃতা দাস অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। চিড়িয়াখানায় তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে সাপ। শহরটাকে মোটের উপরে খুব পছন্দ করেছে বলে মনে হল না, “জানেন, আমাদের গ্রামে ভোর থেকে পাখির ডাক শোনা যায়। এখানে পাখির ডাক নেই, লোকে চিড়িয়াখানায় যায় পাখি দেখতে। আমাদের মৌসুনি দ্বীপে চলুন না, দেখবেন সূর্যাস্ত কী সুন্দর, কত পাখি। বাঁধের ধার থেকে রোজই প্রায় দেখি।”
তারপরেই জিজ্ঞাসা করল, “আপনার বাড়ি কোথায়, কলকাতায় থাকেন?”
“আমি কলকাতায় থাকি না, আমার বাড়ি দামোদরের ধারে।”
“ও, তা হলে তো আপনাদের ওখানেও বন্যা হয়!”
এরা শুধু নিজের এলাকা সম্বন্ধেই জানে এমন নয়, আরও অনেক কিছু জানে। চিড়িয়াখানার কোন কোন পাখি তাদের দ্বীপে দেখা যায়, কোন কোন প্রাণী দেখে কেন অবাক হয়নি (যেমন ওদের গ্রামেও কুমির আছে), সে সব গুছিয়ে বলতে থাকে। কথার ফাঁকে সকলের নামগুলোই জানা হল না!
ঘর জলে গেলেও খেলাঘর ধরে রাখার কৌশলটা ওদের মজ্জায়। (ছবি: কৌশিক চট্টোপাধ্যায়)
দীপিকা বলল, ওর ইংরেজি গ্রামার খুব ভালো লাগে, সমস্যা হয় কমপ্লেক্স সেন্টেন্স নিয়ে। দীপিকা দাসও এ বার দশম শ্রেণীতে উঠেছে।
বাঁধের ধারে যাদের বাস তাদের জীবনে অনেক কিছু না থাকার মধ্যেও একটা জিনিস আছে, তা হল সারল্য।
বছরের একটা সময় ত্রাণকেন্দ্রে কাটানো, জল থেকে বাঁচতে খুঁটির উপরে বাড়ি তৈরি করা, মাটির উনুনের বদলে প্রয়োজনে টিনের উনুনে রান্না করা, সারাদিন হয় জলে না হয় বিছানায় কাটানো, ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা, জল থই থই গ্রামে পানীয় জল জোগাড় করা এবং জল নামলে আবার নতুন করে সংসার সাজানো – এই সংগ্রামে ওদের অস্ত্র হল সারল্য। জটিল – তা সে জীবন হোক বা বাক্য – ওদের যে ভালো লাগবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক।
শহরের স্মৃতি। (ছবি: ডেইলিও)