কোথায় দাঁড়িয়েছে শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক সম্পর্ক?
শিক্ষক ও ছাত্রদের এখন ছোটখাটো সমস্যাকে বিশাল আকারে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে
- Total Shares
পাঁচ বছরের নীহারিকার মা শ্যামলী যখন শুনলেন তাঁর মেয়েকে মাঝে মাঝেই ক্লাস টিচার একা আলাদা বসিয়ে রাখেন, মাথা গরম হয়ে গেল তাঁর। স্কুলে মায়েদের যে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, তাতে চলল এই নিয়ে সরগরম আলোচনা। শুধু তাই নয়, ছোট্ট নীহারিকার সামনেও ক্লাসটিচার সমন্ধে যথেষ্ট কটূ কথা বললেন তাঁর মা। বন্ধুদের সম্মিলীত প্ররোচনায় ক্লাসটিচারের বিরুদ্ধে চিঠি লিখলেন তিনি, সকলের সামনে হেয় করলেন তাঁকে ,শুধু তাই নয় সোশ্যাল মিডিয়াতে উগরে দিলেন সেই ক্ষোভ, অথচ একবারও জানার চেষ্টা করলেন না ঠিক কী কারণে শিক্ষিকা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন! পরে জানা গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটি প্রতিদিন তার সহপাঠীদের কাছে বুলিংয়ের শিকার হত। তাই তাকে স্বস্তি দেওয়ার জন্যই সেই শিক্ষিকা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অথচ এই আসল কারণটা জানার কোনও চেষ্টাই করেননি অভিভাবকরা। এরকম উদাহরণ আজকাল আমরা চারপাশে প্রতিনিয়ত দেখতে পাই!
আমার এক শিক্ষক বন্ধু হতাশ গলায় সেদিন আমায় বলছিলেন, ক্লাস নিতে তাঁর নাকি আর ইচ্ছে করে না! কারণ সবসময় ক্লাসে ঢুকে মনে হয় একটা চাপা দমবন্ধ পরিবেশে শিক্ষাদান করতে হচ্ছে। কোথায় কখন ছাত্রছাত্রীকে সামান্যতম বকুনিও হয়ত লাঞ্ছনার অভিযোগ খাড়া করে দেবে। কোনও ছাত্রী যদি ভালো কিছুও করে, তাহলে তার পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দেওয়ার দিনও শেষ, কারণ অনেকসময় তা থেকে যৌন লাঞ্ছনার মতো গুরুতর অভিযোগ হয়ে ওঠে।
বেশ মনে আছে, আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম কোনও একটি ব্যাপারে রাগ করে আমি শ্রেণিশিক্ষক সম্বন্ধে নেতিবাচক কয়েকটি কথা আমার মাকে বলেছিলাম। প্রতিক্রিয়ায় মা চোয়ালটা একটু শক্ত করে একটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে। একটা প্রবল অপরাধবোধে সেদিন আমার মাথা নীচু হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বর্তমানে আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি যেখানে শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবকদের মধ্যে সম্পর্কের কাঠামোয় বিশ্বাস,শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মতো শব্দগুলোর সত্যি খুব ক্ষীণ হয়ে আসছে। অভিভাবকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে যে কোনও ছোটখাটো সমস্যাকে বিশাল আকারে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে একটা আত্মতৃপ্তির নেশা। এই নেশার জন্য তারা ভুলে যেতে বসেছে যে তারা তাদের সন্তানদের মধ্যে ক্রমাগত বপন করে চলেছেন অবিশ্বাস আর প্রতিশোধমূলক আচরণের বীজ।
এর ফলে আগামী দিনের সমাজ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে চলেছে আমাদের সবার কাছে। ভয় হয়, সেই সমাজের ভিত না হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বাসহীনতা, উপেক্ষা আর প্রতিশোধ স্পৃহা। অভিভাবকদের কাছে আমার একটিই বক্তব্য, শিক্ষাদানের স্থানটিতে যতটা সম্ভব কম হস্তক্ষেপ করবেন ততই ভালো। আপনি যেমন স্বাধীন ভাবে নিজের মতো করে বাচ্চাকে বড় করে তুলছেন, সে রকম শিক্ষক শিক্ষিকারাও কো-পেরেন্ট বা অভিভাবকতুল্য। তাই তাঁদেরও একটি নিজস্ব জায়গা দরকার শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে। সবসময় মনে রাখবেন, আপনি শুধু একটি বা দুটি সন্তানের বড় হওয়া দেখছেন আর ওঁরা প্রতি নিয়ত বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন রকম শিশুকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে দেখছেন। তাই ওঁদের মূল্যবান ও অভিজ্ঞতার কথা সবসময় মাথায় রাখুন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসাবে আপনার সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রের কোনও বিষয়ে মতান্তর হতেই পারে,কিন্তু তা সমাধানের তো অনেকরকম সুস্থ উপায়ও রয়েছে।
আপনার সন্তানের সামনে নাই বা করলেন সেই সব আলোচনার ও বিশ্লেষণ! এটা কি খুব একটা কঠিন কাজ? অভিভাবকদের ক্ষেত্রে আত্মসম্বরণ খুব প্রয়োজন একটি বাচ্চাকে সুস্থ ভাবে বড় করে তুলতে গেলে।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উদ্দেশ্যেও আমার একটি অনুরোধ রয়েছে। আপনারা সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না। কারণ আপনাদের হাতেই রয়েছে সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি। কথায় বলে, শাসন করে যে সোহাগ করে সে। এই সমীকরনটি হয়ত কোথাও এখন সঠিক ভাবে পালিত হচ্ছে না। কোথাও হয়ত শিশুদের মনে অনেক অভিমান জমা হচ্ছে।
অধিকাংশ বাচ্চাই এখন ছোট পরিবারে বড় হচ্ছে। অনেকে তো ঠাকুমা-দিদিমার ওমটুকুর সুযোগও পায় না। স্কুলে এসে তারা শুধু খুঁজে বেড়ায় একটু ভালোবাসা আর আপনাদের সান্নিধ্য। দুষ্টুমি করলে নিশ্চয়ই যেমন বকবেন তেমনই দিনের শেষে বাড়ি ফেরার আগে হয়ত বাচ্চাটির শুকনো মুখটা আপনার মিষ্টি কথায় উজ্জ্বল করে দিলেন। ওদের মন বড় নরম।
আপনার সামন্যতম যত্নও ওর সারাদিনের বকুনি ও গ্লানি ভুলিয়ে দেবে। শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অভিভাবক এই দু'পক্ষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের খুঁটি যদি মজবুত হয়, তাহলে আমাদের নতুন প্রজন্মকেও আমরা সঠিক মূল্যবোধের সঙ্গে বড় করতে পারব। এটাই তো আমাদের পরম প্রাপ্তি।