আপনার সন্তান যাতে তোতলামি না করে তাই কথা বলার সময় তার উপর চাপ সৃষ্টি করবেন না
সঠিক সময়ে স্পিচ থেরাপি শুরু করতে পারলে তোতলামি সম্পূর্ণভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব
- Total Shares
তোতলামি বা স্ট্যামারিং (Stammering) হল কথা বলতে গিয়ে আটকে যাওয়া বা কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে অসুবিধা হওয়া। তোতলামি জন্মগত সমস্যা নয়, কোনও শিশু যখন কথা বলা শুরু করে তখন থেকেই তার মধ্যে তোতলামির ভাব দেখা দেয়।
একটি শিশুর মস্তিষ্কে একই সময় অনেকগুলো ভাবনা ভিড় করে আসতে শুরু করে এবং সে নিজের কথার মাধ্যমে মনের সবকটি ভাবকে ব্যক্ত করার চেষ্টা করে যার ফলে তার মস্তিষ্কের সঙ্গে কথা বলার গতির সামঞ্জস্য অনেক সময় থাকে না। তাই তখন তাড়াতাড়ি কথা বলতে গিয়ে সে তোতলামি করে ফেলে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে তোতলামির ক্ষেত্রে একটা ইংরেজি কথা প্রায়শই ব্যবহার করা হয় সেটা হল 'স্টাটারিং ইজ ইন দা ইয়ার্স অফ দা পেরেন্টস অ্যান্ড নোট ইন দা মাউথ অফ দা চাইল্ড।' অর্থাৎ একজন শিশু যখন প্রথম তোতলামি করে তখন সে নিজে বুঝতে পারে না যে, যে তোতলামি করছে কিন্তু শিশুটির অভিভাবক তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে সচেতন করতে থাকে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সেই শিশুটি বুঝতে পারে যে তার বয়সী আর পাঁচটা শিশুর মতো করে সে কথা বলে না তাই ক্রমশ এই সমস্যাটা যত বাড়তে থাকে ততই সে নিজেকে অন্যদের থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। ফলে শিশুটি খুব আড়ষ্ঠ হয় পড়ে। শিশুর উপরে কোনও রকম চাপসৃষ্টি করা উচিৎ নয়। ৬৫ শতাংশ শিশুদের যদি তাদের কথা বলার এই সমস্যার বিষয়ে সচেতন না করা হয় অল্প সময়ের মধ্যে তারা নিজেরাই এই সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে পারে। তবে একটি শিশু যদি তার পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে না পারে তাহলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাটা ক্ষীণ হতে থাকে। শৈশব শেষ হয়ে গেলে বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিক্ষণে সমস্যাটির নিরাময়ের প্রবণতাটা খুব কমে যায়।
ছেলেদের মধ্যে তোতলামির প্রবণতা বেশি প্রায়, মেয়েদের সাপেক্ষে অনুপাতটা প্রায় ২-১। তবে মেয়েদের মধ্যে তোতলামি সেরে যাওয়ার প্রবণতাও ছেলেদের চেয়ে বেশি।
বড়দের ক্ষেত্রে তাঁদের তোতলামি থাকলে তাঁরা অন্যদের সঙ্গে খুব একটা কথোপকথন চালাতে চান না আর যদি কথাও বলতেই হয় তাহলে দু-এক কথায় কথা সারেন। কারণ তাঁদের মধ্যে সব সময় তাঁদের কথা আটকে যাওয়ার একটা ভয় কাজ করে। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে এঁরা নির্ধিষ্ট কোনও একটা শব্দ উচ্চারণ করার সময় আটকে যেতে পারে ভেবে সেই শব্দটিকে অন্য আর একটি শব্দ দিয়ে বদলে দেন।
অনেককেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন সমস্যাটা ওষুধের সাহায্যে সারানো যায় কি না? এই সমস্যাটি নিরাময়ের ক্ষেত্রে স্পিচ থেরাপি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে হালকা কিছু ওষুধ দিয়ে স্নায়ুকে শান্ত রাখা হয়। সঠিক সময়ে স্পিচ থেরাপি শুরু করতে পারলে তোতলামি সম্পূর্ণ ভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব।
স্পিচ থেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এমন বহু মানুষকে দেখেছি যাঁরা স্বস্ব ক্ষেত্রে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে গেলেও শুধু মাত্র তোতলামির কারণে একেবারে প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন। কারণ তাঁদের সব সময় একটা ভয় কাজ করে যে কারোও সঙ্গে কথা বললে তাঁর তোতলামি ধরা পড়ে যাবে। আবার এমন অনেক অল্পবসয়ী মানুষকে দেখেছি যাঁরা তোতলামির জন্য নতুন করে কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন না এমনকি বিবাহেও তাঁদের অনীহা। তাঁদের উদ্দেশে আমি বলব, বাইরে গেলেই আবার এমন অনেক মানুষকে আমি জানি যাঁরা আবার কেউ হয়তো নিজের অফিসে দারুন ভালো কাজ করে শুধু মাত্র বসের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাফল্যের কথাটা বলতে পারছে না তাই তাঁর সহকর্মী পুরো সুনামটা পেয়ে যাচ্ছে এবং আসল লোকের পদোন্নতি আটকে যাচ্ছে। তাই বহু বছর ধরে সমস্যাটিতে ভুগতে ভুগতে এবং নিজেকে অন্যদের সামনে ব্যক্ত করতে না পারার ফলে তাঁর মধ্যে একটা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে যার থেকে তাঁকে একটা অবসাদ গ্রাস করছে।
সমস্যাটির থেকে মুক্তি পেতে হলে কয়েকটা নিয়ম একটু মেনে চলা প্রয়োজন যেমন
*আপনার সন্তানের মধ্যেও যদি এই সমস্যাটা দেখা দেয় তাহলে নিজে সচেতন হন, শিশুটিকে সচেতন করতে যাবেন না।
*শিশুকে তার নিজের কথাটা শেষ করতে সময় দিন তাকে কখনোই তার কথাটা শেষ করতে তাড়া দেবেন না।
*শিশুটিকে একসঙ্গে বা একবারে অনেকগুলো প্রশ্ন করবেন না।
*আমাদের কাছে এমন অনেক মানুষ আসেন যাঁরা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যেতে কুণ্ঠা বোধ করেন। তাঁদের আমি পরামর্শ দেব যে তাঁকে যখন কোনও প্রশ্ন করা হচ্ছে তখন জবাবটা তড়িঘড়ি না দেওয়ার চেষ্টা করে আগে মনে মনে ১-২-৩ গুণে তারপর চোয়ালটা হালকা রেখে ধীরে ধীরে কথা বলা শুরু করুন।
*পাশাপাশি আমরা 'এয়ার ফ্লো ম্যানেজমেন্ট থেরাপি' ব্যবহার করি। অর্থাৎ আমরা একজন ব্যক্তিকে আগে কিছুটা নিশ্বাস হালকা করে মুখ দিয়ে ছাড়তে বলি ও তারপর ধীরে ধীরে কথা বলা শুরু করতে বলি।
একদম শেষে বলি বহু নামি ব্যক্তিদের যেমন অভিনেতা হৃতিক রোশন, কঙ্গনা রানাওয়াত থেকে হলিউডের মেরিলিন মনরোর এই সমস্যাটি ছিল এবং এখনও অল্পবিস্তর রয়েছে। তাই হতাশ হওয়ার তেমন কোনও কারণ নেই শুধু নিজের উপর বিশ্বাসটা রাখতে হবে আর প্রয়োজনে চিকিৎসক বা স্পিচ থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।