প্রতিবাদী হচ্ছে নারী, তাই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অবলা শিশু
নারী সামাজিক ভাবে একটাই অবহেলিত যে তাকে ব্যক্তি নয়, বস্তু বলে ভাবা হয়
- Total Shares
ধর্ষণ সম্পর্কে কিছু লিখতে বা বলতে গেলে আর কোনও বিশেষ ঘটনার উল্লেখ সম্ভব হয় না। এই ঘটনা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে সন্ধ্যাবেলা কফি খেতে খেতে উদ্বেগহীন হয়ে টিভিতে মানুষ এ খবর শোনে, যেন এত স্বাভাবিক, এ ঘটনা যেন কোনও খবরই নয়। এ খবরে মানুষের অনুভূতি আর সাড়া দেয় না, বরং আরও কত উত্তেজনামূলক খবর আছে। তবে সব খবরই বোধহয় আগ্রাসনমূলক। কিন্তু কেন এই আগ্রাসী মনোভাব ক্রমশ মানুষের মনকে ছেয়ে ফেলেছে? এই ধর্ষণকে শুধু নিজের কাম চরিতার্থতা নাকি এর মধ্যেও অন্য কোনও আগ্রাসী মনোভাব মিশে আছে?
যখন ধর্ষণ ক্রোধের প্রকাশ হিসাবে ঘটে তার উদেশ্য মূলত ধর্ষণ ও কুরুচিকর কথার মাধ্যমে ও ধর্ষণের মাধ্যমে ওই নারীকে চূড়ান্ত হেনস্থা করা, হেয় করা ও অবজ্ঞা করা। ক্রোধ যেন এক নারীকে আবিল করে, কলুষিত করে এবং ধর্ষণ যেন এক মহিলাকে জব্দ করার মোক্ষম অস্ত্র। নারকীয় অত্যাচার করলে তবেই যেন তার আগ্রাসী মনোভাব চরিতার্থ হয়।
যখন জীবনের অন্য ক্ষেত্রে তার কোনও ক্ষমতার যথার্থ প্রকাশ ঘটে না, সে সম্মানজনক কোনও কাজে যুক্ত হতে পারে না এবং তার আত্মমূল্যায়ন তলানিতে এসে ঠেকে, তখন তার শক্তি দেখানোর ক্ষেত্র যেন তার জৈবিক শক্তির প্রকাশ করে বাহাদুরি দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা। তারা যে শুধু ধর্ষণ করছে তাই নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেও এই আগ্রাসী মনোভাব চরিতার্থ তারা করে। ধর্ষণ করে একটি মহিলাকে বিধ্বস্ত করে হত্যা করে তার প্রবৃত্তির বিজয়ধ্বজা ওড়ানোই যেন তার ক্ষমতা প্রদর্শনও একটি চরম উপায়। এক নারীকে লালসা চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে দেখছে এবং তাঁকে যন্ত্রণা দেওয়ার মধ্যে আনন্দ পাচ্ছে। আবার গণধর্ষণ যখন হয়, তখন সেই দলের প্রত্যেকেই একে অন্যের কুকর্মে সম্মতি দিচ্ছে।
ধর্ষকের শাস্তি তো প্রমাণসাপেক্ষ, যার সাক্ষী সাবুদ না পেলে সে মুক্ত (ছবি: পিটিআই)
অন্য সব প্রাণীর মতো মানুষও কয়েকটি প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মায়। প্রবৃতিগুলোর পিছনে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যও থাকে। প্রকৃতি তো কিছু কিছু চাহিদা আমাদের মধ্যে তৈরি করে না, তাই যেমন ফ্রয়েড ভেবেছিলেন যৌন প্রবৃত্তি শুধু মাত্র জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য নয়, অবশ্য সেটাও খুব জরুরী আমাদের প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু আমাদের আত্মিক উন্নতি, মানে বৌদ্ধিক বিকাশ, সৃষ্টিমূলক কাজ আত্মোন্নয়নের তাগিদ, সামাজিক মেলামেশার পেছনেও এই প্রবৃত্তি অর্থাৎ সেক্স ইনস্ট্যান্টই কাজ করে। পরবর্তীকালে তিনি এই প্রবৃত্তিটিকে লাইফ ইনস্টিঙ্কট হিসেবে অভিহিত করেন।
আবার নিজের বাঁচার তাগিদে খাদ্য ও খাদকের দ্বন্দ্ব তো আছেই তখন নিজের বাঁচার জন্যই খাদককে আগ্রাসী মনোভাবের আশ্রয় নিতে হয়। একসময় হয়ত দুই যুযুধান পক্ষ সম্মুখীন হত বাঁচার তাগিদেই, তখন তাদের আক্রমণাত্মক হতে হত। কিন্তু এখন যখন আমরা বুদ্ধি বলে বলীয়ান বলে গর্বিত বোধ করি, যখন বৌদ্ধিক মস্তিষ্কের বিকাশ মানুষের অযৌক্তিক প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে, বুদ্ধি যখন অবাঞ্ছিত আবেগকে দমন করতে পারে, কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে, তখন কেন এ কাজ করে? এটি বেদনাদায়ক।
মানুষ অনিয়ন্ত্রিত ভাবে সামাজিক প্রতিপত্তি, লোভ লালসার শিকার হয়ে নিজের জৈবিক প্রবৃত্তির উর্ধ্বে উঠতে না পেরে কখনও কখনও স্বজাতিরও ক্ষতি করতে পিছপা হয় না। মানুষ ব্যতীত অন্য জীবকুল বোধহয় অকারণ তার আগ্রাসী মনোভাব ব্যবহার করে অপরের ক্ষতি করে না।
প্রকৃতি এই অত্যাচারের শিক্ষা আমাদের দেয়নি। তাহলে কি সামাজিক কোনও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই এই মানসিকতার বীজ সুপ্ত আছে?
সন্তানের জন্মের ক্ষেত্রে জৈবিক ভাবে (ক্রোমোজমের হিসাবে) মা ও বাবার ভূমিকা সমান থাকে। কিন্তু বাস্তবে সন্তানদের কাছে, তা সে ছেলে হোক বা মেয়ে, বে শি প্রিয় হন মা।
নারীজাতির আবার মানুষ রূপ কোথায় আছে? (ছবি পিটিআই)
বাড়িতে যখন দেখা যায় মা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছেন বা বাইরে কাজ করে রোজগার করছেন তখনও বাবা কিন্তু কর্তা। শুধু রোজগার করলেই তো হয় না, বাড়ির সব সিদ্ধান্ত নেয় কে? আবার মা যখন অত্যাচারিত হন বা মাকে ছোট করা হয় বা হেনস্থা করা হয় বা যখন শিশু দেখে মাকে সব চেয়ে বেশি আপোস করতে হয়, বা মা বাড়িতে খাটাখাটনি করলেও বাবারই দাপট বেশি কারণ তিনি রোজগার করেন, মায়ের পরিশ্রম কোনও ভাবেই অর্থাগমের সঙ্গে যুক্ত নয়, তখন কোনও ছেলেকে মেয়েদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পাখিপড়ানোর মতো করে তৈরি করতে হয় না। তার মধ্যে আপনিই আসে - মেয়েরা ছেলেদের সমান নয়। মেয়েরা কমজোর। তাই মেয়েদের চোখের জলে প্রথম দিকে শিশুমন ব্যথার্ত হলেও যখন দেখে মা পড়ে পরে মার খাচ্ছেন, অত্যাচারিত হচ্ছেন বা অসম্মানিত হচ্ছেন তখন তার মায়ের ব্যাপারে ঠিক ততটা সমব্যথী হয় না, মায়ের সঙ্গে নিজেকে মেলাতেও পারে না বা চায় না।
কেন মেলাতে চায় না? কারণ মা তো দুর্বল, মায়ের তো শক্তি নেই মায়ের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে হলে হলে সে নিজেকে দুর্বল হিসেবে দেখতে শুরু করে। শিশুমনে নিজের অস্তিত্ব অরক্ষিত হওয়ার ভয় হয়। তাই সে যাদের দিকে ক্ষমতা, তাদের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে চায়। তাদের মতো হতে চায়। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নারীকেহীন চোখে দেখার মানসিকতা তৈরি হয়। যখন নিজের বোনকে বাড়ির কাজ করতে শেখানো হয়, নিচু স্বরে ও ধীরে কথা বলা শেখানো হয় এবং বড় হলে একা বাড়ির বাইরে বেরনো নিষিদ্ধ হয়। আর বিয়ে না হলে সে বাপ-মার গলার ফাঁস হয়ে থাকে। মেয়েরা একটা ‘বস্তু’ ছাড়া আর কী? সে এখন একটি ‘বস্তু’, যাকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তাকে পুরুষের পাশাপাশি মানুষ নামে সমগোত্রীয় করে কী করে রাখা যায়? তাই সে ব্যবহার্য্য বস্তু।
তাকে বিয়ে করলে পণ দিতে হয়, কিন্তু সেই পণ দিয়ে মেয়ের বাবা কিন্তু জামাইকে কিনে নিতে পারেন না। কারণ সেই টাকা মেয়েকে তার শশুরবাড়িতে সারাজীবন ভরণ-পোষণ করানোর বিনিময় হিসাবে দেওয়া হচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির পরিবারের অর্জিত কিছুতে অধিকার তো তার নেই। সেই স্ত্রী হয় স্বামীর ক্ষুধা মেটানোর জন্য, এক বস্তু এই ঘরকন্নার ভার উদ্ধারের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র, সে সন্তান ধারণের জন্য। সেই নারীজাতির আবার মানুষ রূপ কোথায় আছে?
তাই পাশবিক প্রবৃত্তি বলে পশুকে অপমান না করে বলি, এই বিকৃতমনা মানুষ সমাজেরই তৈরি। সে বংশের ধারার রক্ষক, এটাই তার সর্বোচ্চ যোগ্যতা, তাই সে ভোগের অধিকারী। তাই ধর্ষণের এই চরম ঘৃণিত প্রকাশ বোঝায়। আমাদের অজান্তেই নৃশংসতার বীজ সমাজে লালিত হচ্ছে। আর এই ধর্ষণকারীরা প্রশ্রয় তো পায়ই, কারণ তার আচরণে কলুষিত হচ্ছে নারী, এখনও সেই নারী মুখ দেখতে পারে না, সেই নারীকে সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এটি আবশ্যিক। আর ধর্ষকের শাস্তি তো প্রমাণসাপেক্ষ, যার সাক্ষী সাবুদ না পেলে সে মুক্ত। হয়ত নারী কিছুটা সচেতন ও প্রতিবাদী হয়েছে, তাই এখন ধর্ষণের বস্তু শিশু যে সত্যিই অসহায় আক্ষরিক অর্থে অবলা এবং যার প্রতিরোধক্ষমতা বা নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা নেই।