পার্থ দে বা শুভব্রত মজুমদার: সামাজিক সচেতনতার অভাব হচ্ছে কোথাও?

মনের অসুখ বা মনোবিকার এই মানুষগুলোকে জীবনের এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে মেনে নিতে দেয়নি

 |  4-minute read |   08-04-2018
  • Total Shares

শুভব্রত মজুমদার তাঁর মায়ের দেহ তিন বছর ধরে সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন - কলকাতার এই ঘটনা আজকের খুব বড় খবর, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবিনসন স্ট্রিটের পার্থ দের কথা। প্রায় ছ'মাস ধরে আগলে রেখেছিলেন তিনি তার দিদি ও পোষা কুকুরদের মৃতদেহ।

রবিনসন স্ট্রিটের ঘটনা সামনে আসার পর আমরা সবাই হতবাক স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। এ রকম ঘটনা তো আগে শোনা যায়নি! তারপর শহর জুড়ে মানুষের কী উন্মাদনা - সেখানে যাওয়া, ছবি তোলা বা সেলফি নেওয়া, বাড়িটিকে 'হানাবাড়ি' আখ্যা দেওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি শেয়ার করা আরও কত কী!

কিন্তু এমন তো নয় যে এই বাড়িটা শহরের কোনও নির্জন প্রান্তে অবস্থিত কিংবা জনসমাজের বাইরে? তাইতো খবরটা প্রকাশ্যে আসার পর লোকজন অবলীলাক্রমে সেখানে যাওয়া আসা করছেন। হয়ত মনের কোনও অসুস্থতা কিংবা কোনও মনোবিকার এই সব মানুষের জীবনের এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে মেনে নিতে দেয়নি। মৃত্যুর পরেও জীবনকে ছেড়ে যাওয়া সেইসব মানুষই তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে রয়ে গিয়েছিল।

দুর্গাপুরের ছেলেটি তাঁর অসুস্থতার জন্য বুঝতেই পারেননি তাঁর মা আর নেই। আবার মনে করা হচ্ছে যে শুভব্রত হয়ত তাঁর মায়ের দেহ সংরক্ষণ করে কিছু আর্থিক সুবিধা পাওয়ারও চেষ্টায় ছিল। কিন্তু কাগজে দেখলাম তিনি বহু টাকা ব্যয় করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন এবং তিনি বহু লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিদেশেও গেছেন। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করে মাকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও পোষণ করেছেন - তা যে যে অবস্থাতেই হোক না কেন। যে কারণেই হোক এটা তো সত্যি কথা যে মনের কোনও বিকারের জন্যই মৃত্যুর পরেও মৃতদের একমাত্র আশ্রয় হিসাবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন।

body_040818063820.jpg শুভব্রত মজুমদার (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

সমাজে আমাদের নিজেদের অবস্থান নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন উঠছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিনোদন ও ভোগের সম্ভারের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সমাজে ও জীবিকার প্রয়োজনে শিকড় ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার তাগিদে মানুষ কী মনের দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে?

উন্নতির সোপানে ওঠা তো বর্তমান জীবনের একটি বড় লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে মানুষ এখনও খুব সহজেই এখান থেকে সেখানে ছুটে বেড়াতে থাকে। পিছনে ফিরে তাকানোর তাঁর সময় নেই। তাই এক জায়গায় সম্পর্ক আলগা হয়ে যায়, অন্য জায়গায় বাঁধন তৈরি হয়। আবার যদি উন্নতির ডাক আসে যশ ও সম্মানের হাত ধরে বা টাকাপয়সার হাত ধরে তখনই সেই বাঁধন আলগা করে চলে যেতে হয় তাঁকে। তাই প্রয়োজন ফুরোনোটা কেমন সহজ হয়ে গেছে। দাগ কাটে না মনে। তাই প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত না হলে সম্পর্ক গড়তেও ভুলে গেছি আমরা। এই ধরণের কোনও ঘটনা ঘটলে সেখানে গিয়ে সেলফি তোলায় আমরা অনেক বেশি উত্তেজিত। আমার পাশের বাড়ির মানুষটা কেন এত অন্যরকম, কেন তিনি কথা বলেন না, কেন তিনি বেরিয়ে না, কেন তিনি কারও সঙ্গে মেলামেশা করেন না, যে মানুষটাকে দেখতাম এত দিন তাকে আর দেখি না কেন, বা হঠাৎ মানুষটা কেন বদলে গেলেন -এই প্রশ্ন আমাদের মনে আসে না। শুধু তাই নয় এই ঘটনা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। আমরা আমাদের প্রয়োজনের বাইরে অন্য কারও সম্পর্কে নিস্পৃহ। যদিও বা কখনও প্রশ্ন জাগে মনে, তখন তাতে আমরা তেমন আমল দিই না। তা না হলে পার্থ দের আত্মহননের দায় কী সম্পূর্ণ ভাবে এড়াতে পারি আমরা? বরং হরিণঘাটায় যখন দুই ভাই মায়ের দেহ আগলে রেখেছিলেন বোধহয় শহরের জীবনের থেকে একটু ভিন্নতর জীবনধারার জন্যই প্রতিবেশীদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, দেবীকে আর দেখছি না কেন? বা ছেলেরা খাবার কিনে আনছে কেন? তাই হয়ত কোনও অছিলায় ঢুকে পড়েছিলেন সেই বাড়িতে।

হয়ত সত্যি এত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাঁরা জীবনযাপন করেন, অন্যের প্রশ্নের তাঁরা বিরক্তি বা রাগ প্রকাশ করবেন- কিন্তু যে মানুষটা স্বাভাবিক জীবনের নিয়মের পরিপন্থী জীবন যাপন করছেন, নিজের জীবন সম্বন্ধে গোপনীয়তা বজায় রাখছেন, সমাজের সঙ্গে যিনি যুক্ত হতে পারছেন না - তিনি বিরক্ত হলেন নাকি রাগ করলেন বা অপমান করলেন, তাতে কী আসে যায়? আমার মানবিক মন তো বলছে সেই মানুষটা কোথাও এতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন যে তিনি চাইলেও সাহায্য প্রার্থনা করতে পারছেন না? তাঁর সাহায্য চাই তিনি কি বুঝছেন না? হয়ত তিনি সাহায্য চান না- কারণ ওই কঙ্কালসার দেহই তার কাছে একমাত্র জীবন্ত সত্ত্বা। সেটাই তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

আমাদের সমাজের কাছে অন্যের দিকে তাকানোর এই প্রত্যাশার কারণ আমাদের সমাজ এখনও তো সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চায়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক (ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক) সমাজেরও তো কিছু নিয়ম থাকে। আমরা ভীষণ নিজেদের সামাজিক কাঠামো (কালেক্টিভিটিক) থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিনির্ভর সমাজের দিকে এগচ্ছি তখন সমাজের অলিখিত যে নিয়মগুলো থাকে -আমরা যেন দু'ধরনের সমাজের কোনওটির বার্তা নিজেদের জীবনে আত্মীকরণ করতে পারছি না। তাই না পারছি সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পরে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারছি এদের সাহায্য করতে পারে এমন দায়বদ্ধ সামাজিক প্রতিষ্ঠা কাছে সেই সংবাদ পৌঁছে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে। বেহালায় ক্ষেত্রে একজন দ্বিতীয় পন্থায় বোধহয় বেঁচে নিয়েছিলেন।

হয়ত একদিকে আমরা সংবেদনশীলতা হারাচ্ছি আর একদিকে নিজেরা যখন অসহায় বোধ করছি তখন পাশে সংবেদনশীল মনের অভাব অনুভব করছি।

তাই মনে হয়, মনোবিকার ও তার দরুণ অস্বাভাবিক ব্যবহার ও অস্বাভাবিক জীবনধারা যে আমাদের কাছে আনকোরা নতুন তথ্য বা নতুন অভিজ্ঞতা তা নয়। কিন্তু যা লক্ষণীয় তা হলে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের শিক্ষাদীক্ষা আপাত মানসিক বিকাশ ও স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের বৌদ্ধিক অনুভূতি ও আবেগমূলক এই দুটো দিকেরই যথার্থ বিকাশ ঘটছে কি না। এদের সঠিক মেলবন্ধনই তো জীবন যাপনকে অর্থবহ করে তোলে। নিজের কাছে, অন্যের কাছে মূল্যবান হয়ে ওঠে প্রত্যেকটি জীবন। প্রকৃতিতো আমাদের সব সম্পদ দিয়েই সমৃদ্ধ করে রেখেছে, আমাদের কাজ শুধু জীবনে তার সুচারু প্রকাশ। তাই শুধু শবদেহ আগলানোটাই বিষয়ে নয়। আমরাও যেন কোনও উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, প্রগলভতা, বিচ্ছিন্নতায় তলিয়ে না যাই তাও তো দেখতে হবে। 

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

PROF DR PRITHA MUKHOPADHYAY PROF DR PRITHA MUKHOPADHYAY

Professor, Department of Psychology, Calcutta University

Comment