মেডিটেশন হল মনকে নিয়ন্ত্রণ, এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই
মেডিটেশনের প্রকারভেদ রয়েছে। কোন ধরণের মেডিটেশন কার জন্য উপযোগী তা জানা দরকার
- Total Shares
আজকাল মেডিটেশন শব্দটি সর্বত্র শোনা যায়। ঝাঁ চকচকে ক্লাবের আড্ডায়, গল্ফ খেলার ফাঁকে ছোট ছোট আলাপচারিতায়, নাইট ক্লাবের উদ্দাম গানের লিরিক্স থেকে শুরু করে ঝুলন্ত ভিড় বাসের ঝগড়ার সময় অনেকেই উপদেশ দেন, "মেডিটেশন করুন দাদা শান্তি পাবেন।" অরা মেডিটেশন, কর্মা, পরমাত্মা, সোল শব্দগুলো বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। শব্দগুলোর গভীর অর্থ হারিয়ে গিয়ে হালকা "ইনওয়ার্ডস" বা "বাজওয়ার্ডস" হিসেবে ব্যবহার হয়।
মেডিটেশন শব্দটি বৃটিশ আমলে প্রথম ব্যবহৃত হয়। এই শব্দটি ইংরেজিতে আসে ল্যাটিন শব্দ 'মেডিটেসিও' থেকে। ল্যাটিন শব্দটির বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় "চিন্তা" অথবা 'ভাবনা'। এই একটি বিজাতীয় শব্দের মাধ্যমে ভারতীয় উপদ্বীপ অঞ্চলে একটি বহু হাজার বছরের পরীক্ষিত এবং নিরীক্ষিত একটি বিশাল ছাতার মতো জীবনযাপনের পদ্ধতিকে সঠিক ভাবে বোঝা যায় না। খ্রিস্টান, জুড়াইসম, ইসলামিক সব ধর্মে মনকে একমুখী করার পদ্ধতি লক্ষ করা যায়, বিশেষ প্রার্থনা বা স্পেশাল প্রেয়ার হিসেবে। হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মে মেডিটেশনে নানাবিধ টেকনিক বা প্রকারভেদ দেখা যায়। তার খুব কম ভাগ আমরা শহুরে মানুষজন জানি। এখনও বহু ধরণের মেডিটেশন গুম্ফা, মনাস্ট্রি, গুহা, জঙ্গল, ধৰ্মস্থলে রয়েছে যা আমাদের জ্ঞান চক্ষুর বাইরে রয়ে গেছে।
ছবি: সুবীর হালদার
আজকাল গৃহী বা সংসারী মানুষজন মেডিটেশন করতে আগ্রহী হচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের মেডিটেশন উপায় হল ধর্মীয় গুরুদের কাছে যাওয়া। সেই গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মেডিটেশন বা মনকে শান্ত করার উপায় শেখা। দ্বিতীয় একটি পথ নতুন জেনারেশন বেছে নিয়েছে। তা হল, গুগল করে ইন্টারনেট থেকে মেডিটেশন শেখা। সাইবার জগতে বহু তথ্য এবং তত্ত্ব আছে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যেখানে মেডিটেশনের মাধ্যমে জীবনে শান্তি এবং পরজন্মে উন্নতির কথা দাবি করা হয়।
এই সাইবার জগৎ এবং ধর্মীয় গুরুদের মাঝখানে বহু মানুষ আছেন যাঁরা মানসিক শান্তি পেতে চান কিন্তু এক্ষুনি কোনও গুরুর পায়ে আত্মনিবেদন করতে প্রস্তুত নন। যাঁরা মন শক্ত করে গুরুদের কাছে যাবেন বলে প্রস্তুত হয়েছিলেন তাঁরাও রাম রহিম ইনসান বা আশারাম বাপুদের দেখে একটু দমে গেছেন।
মেডিটেশন শব্দটির জায়গায় আমি যে শব্দটি ব্যবহার করি সেটি হল -"মাইন্ড জিম"। আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে যেটা আমাদের প্রথম দরকার সেটি হল মাইন্ড কন্ট্রোল। না, অন্য কারও মাইন্ড কন্ট্রোলের কথা বলছি না। নিজের চিন্তা নিজের আয়ত্বে রাখার কথা বলছি। বহু ছাত্রছাত্রী, দাবা খেলোয়াড়, তিরন্দাজ, ক্রিকেটার, রাইফেল শ্যুটার ও অন্য খেলার জগতের কলাকুশলীরা মেডিটেশন করেন শুধুমাত্র একাগ্রতা ও শান্ত মনের জগৎ গড়ে তোলার জন্য।
ছবি: সুবীর হালদার
মেডিটেশনের মধ্যে বহু প্রকারভেদ রয়েছে। কোন ধরণের মেডিটেশন কার জন্য উপযোগী সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকা দরকার। ধ্যান-ধারণা, শূন্য, আধ্যাত্মিক গতির মাধ্যমে সাধনা প্রভৃতি বহুবিধ মেডিটেশন পদ্ধতি প্রচলিত আছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন গুরুর কাছে নানান পদ্ধতি আছে। ধর্মের মোড়কের মধ্যে এই টেকনিকগুলো সময়ের সঙ্গে পরীক্ষিত এবং বিজ্ঞানসম্মত। মনঃসংযোগের পদ্ধতিগুলো নিয়ে বহু গবেষণা হচ্ছে। বেশিরভাগ গবেষণাই অবশ্য হচ্ছে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। সবার জন্য একই পদ্ধতি কাজ করে না। ব্যক্তি মানুষের জন্য তাঁদের মানসিক পরিস্থিতি, জীবন যাপনের পদ্ধতি এবং সারা জীবনের বিভিন্ন ঘটনা জেনে নিয়ে তার উপর ভিত্তি করে ধ্যান করার পদ্ধতি তৈরি করা হয়। আমরা মনের জন্য খুব কম সময় দিয়ে থাকি। অথচ মনের জোরে মানুষ শারীরিক বাধা তুচ্ছ করে অনেক বড় বড় কাজ করতে সক্ষম হন। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারলে জীবন সাফল্যমণ্ডিত এবং শান্তিপূর্ণ হতে পারে।
আধুনিক গবেষণা বলছে আলঝইমার্স, এডিএইচডি, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, ইনসমনিয়া থেকে শুরু করে অ্যাংজায়িটি, ডিপ্রেশন, ফিয়ার সাইকোসিস প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্রে মেডিটেশনের কয়েকটি পদ্ধতি খুব ভালো কাজ করে। প্রথাগত চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক পদ্ধতিতে মেডিটেশন করলে সুফল লাভ হয়। মেডিটেশন এবং সাইক্রিয়াটিক একে অপরের পরিপূরক।
প্রাচীন ভারতের জীবনযাপনে পন্থা ছিল ধ্যান। আধুনিক পৃথিবীতে দ্রুত জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাইন্ড জিম এবং মেডিটেশনকে জীবনযাপনের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করতে পারলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ, সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা যাবে।