তাঁদের জন্য যে একটা দিন আছে, শম্ভুর মা-মিনুর মা সে কথা জানেন কি?
একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আদর করে ‘হ্যাপি মাদারস ডে’ বললে মা কী করবেন?
- Total Shares
বিভিন্ন পোর্টালে গত কয়েকদিন ধরে ঢুকলেই পপ্ আপ করছে একগুচ্ছ ফুল, সঙ্গে ছোট্ট মেসেজ ‘দিস্ মাদার’স্ ডে সেন্ড আ কার্ড টু ইয়োর মাদার!’ যদিও আমার মনে মনে, আমার সঙ্গে সঙ্গে তিনি থাকেন সব সময়ই, বস্তুত আমার নিজের মা এখন আর ইহজগতে নেই। ভেবে দেখছিলাম, বছরে হঠাৎ একটা দিন বাড়িতে যদি একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আদর করে ‘হ্যাপি মাদারস ডে’ বলে তা মার হাতে তুলে দিতাম কী চমকেই না যেতেন তিনি, খুশি হলেও নিশ্চয়ই অপ্রস্তুতও হয়ে পড়তেন মা।
আসলে আমরা বাঙালিরা যে সবসময়েই মায়ের আঁচল ঘেরা, তাদের মূল্য আলাদা করে দিতে শিখলামই বা কোথায় আর পারলামই বা কোথায়?
‘মেরা পাস মা হ্যায়!’ কবিতায়, গানে, ছবিতে, যাত্রাপালায়, চলচ্চিত্রে মাকে নিয়ে আমাদের আন্তরিক আদিখ্যেতার ছড়াছড়ি। সেই যে কবে জ্ঞানত ‘মা’ ডেকে আঁকড়ে ধরি তাঁকে ইহজীবনে তিনি না থাকলেও সাধারণ ভারতীয়-সন্তানের জীবনে তাঁর বাঁধন ছিন্ন হয় না কখনও। সকালে ঘুম থেকে তুলে মুখের ডগায় চায়ের কাপ এনে হাজির করা, তারপর জলখাবার, তাড়া দিয়ে চানে পাঠিয়ে- কী পরবে সেই জামা-কাপড় ঠিক করে রাখা থেকে শুরু করে দু’বেলা ভাতের থালা নিয়ে বসে থাকা- সচরাচর অধিকাংশ বাঙালি বাড়ির অন্দরে এমনটাই নিয়ত চলতে থাকে অন্তত জীবনের একটা সময় অবধি।
বড় হয়ে তা নিয়ে বিপাকেও পড়ি আমরা, কেননা আমরা অনেকদিন হাবেভাবে কেমন যেন সেই খোকা বা খুকুটিই থেকে যাই এ জন্য! এখন অধিকাংশ মায়েরাই চাকরি করতে বেরোন, আগের মায়েদের তুলনায় তাঁদের সময় হয়ত অনেকটাই কম কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের মা-সংক্রান্ত ‘অন্দর কী বাত’ খুব একটা পাল্টেছে বলে মনে হয় না।
মেরা পাস মা হ্যায়!
মাকে ছাড়া, মায়ের অমতে বাঙালি বাড়িতে কিছু হওয়া বা করাটা বেশ কঠিনসাধ্য। আর এটা শুধু নিজের মা বলে নয়, মহিলাদের বোধহয় একটা সহজাত ক্ষমতা থাকে, তাঁরা সহজেই নিজের সন্তানের বন্ধু-বান্ধবদেরও মাতৃস্নেহে আবদ্ধ করে নিতে পারেন। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বন্ধুদের থেকেও বন্ধুদের মায়েদের সঙ্গে আমার জমত বেশি। বোধহয় আমার মা চাকরি করতেন বলেই এবং মাকে কিছুটা কম পেতাম বলেই বন্ধুদের মায়েরা আমাকে একটু বেশি বেশি করে ভালোবাসতেন যেন।
আমি গেলে আদর-যত্ন করে থালা সাজিয়ে খেতে দিতেন তাঁরা, ফ্রিজ থেকে বার করে আনতেন রকমারি সব পদ। মহানন্দে সে সব খেতে খেতে বন্ধুদের নামে কুষ্টি কাটতাম আমি, জমে উঠত আমাদের গোপন আলাপ ও আঁতাত! সেইসব অনেক মাসিমাই এখন আর নেই, কিন্তু যাঁরা আছেন এখনও, যখন তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় অনেকদিন পরে পরে, অশক্ত শরীর নিয়েও তাঁরা যত্নের ত্রুটি করেন না কোনও, মেকি রাগ দেখান এত দিন পরে পরে যাওয়ার জন্য। আসার আগে জড়িয়ে ধরে আদরও করেন কত। তাঁদের সবার মধ্যে আমি আমার মা-কেই খুঁজে পাই। বছরে হঠাৎ একদিন ফুল নিয়ে হ্যাপি মাদারস্ ডে জানাতে যাব তাঁদের, নাঃ আমার দ্বারা তা হবে না।
এতো গেল আমার কিংবা সাধারণ ভাবে আমাদের মতো প্রিভিলেজড্ বাড়ির মায়েদের কথা। কিন্তু এর বাইরে জীবনের বিভিন্ন সময়ে আরও নানান মায়েদের কাছ থেকে দেখে চমকে গিয়েছি আমি এবং এখনও দেখে বিস্মিত হই বারে বারে। আমাদের বাড়িতে এবং আশপাশের বাড়িতে নানা সময়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে নিজের সন্তানদের নিজের পায়ে দাঁড় করাতে দেখেছি একাধিক মাকে। দেখেছি, স্বামী-পরত্যক্তা মাকে রুগ্ন অসুস্থ ছেলেকে বা মেয়েকে একা হাতে মানুষ করতে।
কত মিনুর মা, গোপালের মা, গোবিন্দর মা, শম্ভুর মা বা আরও কারও মায়েদের দেখেছি দিন গুজরানের জন্য নিজের কোলের সন্তানকে ঘরে বা পথে রেখে এসে অন্য কোনো বিত্তবান মায়ের সন্তানকে পরম স্নেহে মানুষ করে তুলতে। এমন যে সমস্ত মায়েরা, তাঁদের সম্মান জানানোর জন্য বছরে একটা দিন খুবই কম, রোজই তো তাঁদের কুর্নিশ করা উচিত। কিন্তু সত্যিই কি আর সেটা হয় নাহলে কাগজে কেন বেরোয়- ‘অসুস্থ মাকে ঘরে তালা লাগিয়ে বেড়াতে গিয়েছে কোনো দম্পতি’ অথবা অচেনা অজানা স্টেশনে বা পাড়ায় ডিমেনসিয়াগ্রস্ত মাকে রেখে পালিয়ে গিয়েছে কোনো অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি?
কলকাতায় ভারতীয় সংগ্রহালয়ে রক্ষিত একাদশ শতকের মাতৃমূর্তি
আমাদের দেশের আম-আদমি অথবা শিশুরা আমাদের মতো করে মা-কে কমই পায়, অর্থনৈতিক কারণে তা পাওয়া সম্ভবও নয়। মা তো মা-ই, মাতৃস্নেহের কি কোনও তারতম্য আছে কিন্তু তার কতটুকু প্রতিদান পান সেই সমস্ত মায়েরা, যাঁরা প্রতিদিন নিজের মুখের গ্রাস তুলে দেন সন্তানের মুখে, তাদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য বিসর্জন দেন নিজেদের সাধ-আহ্লাদ? সমাজই বা কী দেয় তাঁদের? আমাদের দেশে অধিকাংশ মায়েরা তো জানেনই না যে তাঁদের সাধ-আহ্লাদ পুরণের জন্যও আলাদা একটা দিন আছে বছরে!