উজ্জ্বল আলোয় অন্ধকার হয়ে যেতে পারে ভবিষ্যৎ
আলোর দূষণ শুধু পরিবেশের নয়, ক্ষতি করছে মানুষের শরীর ও মনের
- Total Shares
মনে করুন তো কবে শেষ বার রাতে খুব শান্তি করে ঘুমিয়েছিলেন আর সকালে যখন ঘুম ভাঙল বেশ ঝরঝরে লাগছিল?
রাতে যদি জানলার কাচ দিয়ে রাস্তার আলো না ঢুকে থাকে, তা সে হালকা হোক বা তীব্র, কিংবা রাস্তায চলা গাড়ির শব্দে আপনার ঘুমে কোনও ব্যাঘাত ঘটে না থাকে তা হলে কি আপনি পাহাড়ে, কোনও বনের মধ্যে বা প্রত্যন্ত গ্রামে রাত কাটিয়েছেন?
আপনার শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মূলে রয়েছে ভালো ভাবে ঘুম না হওয়া – অমূলক ভাবনা থেকে অবসাদ, রক্তশর্করা-মধুমেহ থেকে স্ট্রোক – এ সব কিছুর জন্যই দায়ী সেই ঘুম। প্রিয় পাঠক, আসলে এ সবের নেপথ্যে রয়েছে আলোর দূষণ।
ভুলে যাবেন না – দূষণ মানেই কারখানা ও গাড়ির থেকে বার হওয়া ঘন কালো ধোঁয়ার মেঘ নয়। সহজ কথায় বলা যেতে পারে, অযাচিত, অত্যধিক, অনিয়ন্ত্রিত অথবা বিপত্তিপূর্ণ কৃত্রিম আলোই বড় বড় শহরগুলোতে আলোর দূষণের কারণ।
২০১৯ সালে প্রকাশিত আর্বন ক্লাঈইমেট জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশক ধরে নিয়মিত ভাবে ভারতের বিভিন্ন শহরে ঘরের বাইরে তীব্র আলোর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঔজ্জ্বল্যের প্রভাবে অন্ধ? (ছবি: রয়টার্স)
পবন কুমারের নেতৃত্বে যে সমীক্ষা করা হয়েছে সেই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, “নতুন দিল্লি, তেলঙ্গনা, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও উত্তরপ্রদেশ – যে ভ জায়গায় বাইরের কৃত্রিম আলোর প্রভাব ছিল, সেই সব জায়গায় তা ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আরও বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট ও তামিলনাড়ুও কম আলোর জায়গা থেকে বেশি আলোর জায়গায় পরিণত হয়েছে।”
আলোর মাধ্যমে কী ভাবে দূষণ হয় তা সহজ কথায় এই ভাবে বলা যেতে পারে – আলোকের দ্যুতি, নিয়ন্ত্রণহীন আলো এবং কোনও জায়গায় রাতের বেলায় উজ্জ্বল আলোক, এ ছাড়া আলোকমালা ও এলোমেলো ভাবে আলোর ব্যবহার তো রয়েছেই।
জার্মানির লিবনিজ-ইনস্টিটিউট ফর ফ্রেশওয়াটার ইকোলজি অ্যান্ড ইনল্যান্ড ফিশারিজের (আইজিবি) পরিবেশবিদ ফ্রাঞ্জ হোলকেরের মতে, রাতের দিকে যে কৃত্রিম আলোক ব্যবহার করা হয় সেই আলোকের দ্বারা স্বাভাবিক আলোকচক্র বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে পরিবেশের উপরে আলোর দূষণের প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে রতের পরিবেশের উপরে। তিনি মনে করেন, রাতের বেলার অতি উজ্জ্বল আলোক মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
হোলকের বলেন, “মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ হল নিশাচর এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি নিশাচরের কাছেই যে এই আলো বিপদের কারণ তা নয়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব এবং গাছেদের পক্ষেও এই আলো যথেষ্ট ক্ষতিকারক।”
হোলকার নাকি একথাও বলেছেন যে, “নিশাচরদের স্বভাব বদলে যেতে থাকায় পোকামাকড়, উভচর, মাছ, পাখি বাদুড় এবং বিভিন্ন প্রাণী-সহ জীব বৈচিত্র্যের উপরে উপরেও এর প্রভাব পড়ছে বিশেষ করে জনন, পরিযায়ীদের অভ্যাস প্রভৃতি।”
দক্ষিণ মুম্বইয়ের কলবাদেবীর বাসিন্দা নীলেশ দেশাই ইতিমধ্যেই অতিমাত্রায়, মাত্রাহীন ভাবে ও অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার নিয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন।
তিনি এই পরিস্থিতিকে ‘কার্ফুর মতো পরিস্থিতি’ বলে বর্ণনা করেছেন।
ডেইলিও-কে দেশাই বলেন, “ওদের চোখের ক্ষতির আশঙ্কা করেই আমি আমার সন্তানদের বলেছি ওরা যেন জানলার দিকে না তাকায়। টিভি দেখার সময় হোক বা ঘুমনোর সময়, তীব্র আলোর হাত থেকে এবং বাঁচতে কোথাও মোটা পর্দা লাগিয়েছি, কোথাও দরকার মতো খড়খড়ি লাগিয়েছি।”
শুভ রাত্রি? আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র থেকে সন্ধ্যায় তোলা প্যারিসের ছবি। (সূত্র: নাসা)
মহারাষ্ট্র সরকার যখন আলোর দূষণকে দূষণের অন্যতম কারণ হিসাবে মেনে নিয়েছে এবং মুম্বই শহরের কালেক্টরেট যখন উইলসন জিমখানা ও মেরিন ড্রাইভকে তাদের ফ্লাডলাইট কমিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন তখন দেশাইয়েই লড়াইও ফলপ্রসূ হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষের শরীরের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার ছন্দ (যাকে সার্কাডিয়ান রিদম বলা হয়) নির্ভর করে প্রাকৃতিক আলোকের উপরে এবং মেলাটোনিন (যে হরমোন মূলত জননের সঙ্গে যুক্ত) নিয়ন্ত্রিত হয় রাতের অন্ধকারে। দেশাই বলেন, “বিভিন্ন ভাবে লোকে আলোক দূষণের শিকার হচ্ছে তবে ভারতে আমরা এই দূষণকে ঠিক উপলব্ধি করে উঠতে পারিনি।”
আলোক দূষণের ফল সম্বন্ধে লোককে সজাগ করার ক্ষেত্রে বিশাল ফাঁক রয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত এই দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনও আইন তৈরি হয়নি। দেশাই বলেন, “আমি এক সময় এটাকে রাতের দিকের একটা সমস্যা বলেই মনে করতাম। আমি যখন আওয়াজ আউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সংস্পর্শে আসি তখন তার নির্দেশক সুমাইরা আব্দুল আলি ‘দূষণ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তখনই আমি অন্য ভাবে ভাবতে শুরু করি। যখন আমি ‘আলোকদূষণ’ শব্দটি ব্যবহার করি তখন তা অন্য মাত্রা পায়, সমস্যাটি ঠিক যে ভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত ঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিচার করেন।”
হেডলাইট থেকে রাস্তার আলো ও অনাবশ্যক ফ্লাডলাইটের তীব্রতা – তীব্র আলোর যতগুলো উৎস রয়েছে সেই সবক’টি উৎসকেই নিয়ন্ত্রণ করতে মাত্রা বেঁধে দেওয়া উচিত নিয়ামকের।
সংবিধান ২১ ধারা আমাদের অধিকার দিয়েছে দূষণমুক্ত পরিবেশে বসবাস করার। যতদিন পর্যন্ত এই ধরনের সমীক্ষা এবং নীলেশ দেশাইয়ের মতো সচেতন নাগরিকদের যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়া হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমরা সংবিধানের ২১ ধারা লঙ্ঘন করেই চলব।
ভবিষ্যৎটা মোটেই উজ্জ্বল হবে না।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে