কুমায়ুনের রাজসিক পর্বত আমাকে কী ভাবে লিখতে শিখিয়েছে
পাহাড়ের নীরবতা আমাকে নিজের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে
- Total Shares
আপনি হয়তো অনককেই পাহাড় ও বৃষ্টি নিয়ে বলতে শুনে থাকবেন, তবে বৃষ্টি এমন একটা ব্যাপার যা কোনও লেখকের সেরারা বার করে আনে। রাসকিন বন্ড তাঁর রেন ইন দ্য মাউন্টেন্স-এ লিখেছেন, “তার সেই শব্দ পড়তে পড় ভালো লাগে – বাইরে বৃষ্টি আর ভিতরটা শান্ত – তাকে স্পর্শ করলে দারুণ অনুভূতি হয়, স্পর্শ না করলেও – বৃষ্টি।”
আচমকা বৃষ্টির পরে পাহাড়টা কেমন ঝকঝকে হয়ে গেল – অফিসের রোজকার রুটিন-কাজকর্ম আর টুকিটাকি কাজের ফাঁকে প্রত্যেক দিন পাহাড়ের সেই সৌন্দর্য অনুভব করার সময় পাওয়া যায় না। শীত পড়ার আগে আমি দিনকতক পাহাড়ে কাটিয়ে এলাম, আমি ছিলাম নৈনিতালে আয়ারপাট্টা উৎরাইয়ে, পিলিভিটের মহারাজার একটি রিসর্টে। সেখান থেকে আমরা নৈনি হ্রদ বা নৈনি তাল এবং নৈনা দেবির মন্দিরের এক অনাবিল সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম। কুমায়ুন পর্বত ও হ্রদের উপরে জলভরা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন একটা দৃশ্যপট দেখে মনে হয় যেন পটে আঁকা ছবি। আমরা বর্ষার ঠিক পরেই পাহাড়ে গিয়েছিলাম – সেটা ছিল পর্যটনের সেরা সময়ের কিছুদিন পরে – তাই সেই পাহাড় ছিল নির্জন, যা ছিল আমাদের কাছে উপহারের মতো। পাহাড়ের নৈঃশব্দ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছিল নিজের সঙ্গে কথা বলার।
নৈনি রিট্রিট থেকে আয়ারপাট্টা স্লোপের দৃশ্য (ছবি: হিমাংশু শেখর)
পাহাড়ি এলাকায় পর্যটনই হল মানুষের প্রধান জীবিকা। তাই পর্যটক হিসাবে একটা ব্যাপার আপনি খেয়াল করতেই পারেন তা হল মল রোডে জিনিসপত্রের যা দাম, এখানে সেই একই জিনিসের দাম তার চেয়ে কিছুটা বেশিই। যাই হোক এ সব নিয়ে গবেষণা করার আগে ও টাকা-পয়সার হিসাব করার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন যে এ সবের জন্য যেন বেড়ানোর আনন্দটা মাটি না হয়ে যায়।
একটু আগে থেকে পরিকল্পনা করে চলছে আপনার খরচ কিছুটা বাঁচবে, এমন সুন্দর ভাবে কাটাতে পারবেন যে সেটা আপনার কাছে মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে। নৈনি রিট্রিটে একটা দিন থাকার পরে আমরা ঠিক করলাম যে এমন একটা জায়গায় থাকব যেখান থেকে আরও ভালো দৃশ্য দেখা যায়, যে দৃশ্য হবে অনেক বেশি পার্থিব ও আদিম। ব্যাপারটা হল, ঘরের থেকে বেরিয়ে হোম-স্টেতে থাকা।
তার পরে আমরা গেলাম রামগড়ে, এই জায়গার নামডাক আছে বেশ কয়েকটি আশ্রমের জন্য, তার মধ্যে একটি হল গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশ্রম। এ ছাড়াও নামী হিন্দি লেখক রামধারী সিং 'দিনকর', মহাদেবী ভার্মা এবং সচ্চিদানন্দ হিরানন্দ বাৎসায়ন ‘অজ্ঞেয়’ একসময় এখানে বাড়ি তৈরি করেছিলেন।
রামগড় আসলে নৈনিতালের মতো নয়, এই জায়গাটা অনেক বেশি শান্ত ও ঘুমন্ত এবং এখানে ভাবনার জন্য অনেক সময় পাবেন, বুঝতে পারবেন কেন কবি-লেখকরা বারে বারে এই জায়গায় আসতেন।
রামগড়ে আপনি দেখতে পাবেন নিসর্গের এক অনাবিল রূপ (ছবি: হিমাংশু শেখর)
আমরা একজনের বাড়িতে ছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির কোলে বিশ্রাম করার সময় কুমায়ুনের নিজস্ব স্বাদের খাবার খাব। এই বাড়ি থেকে নিম্ন হিমালয়কে অনবদ্য দেখায় আর তার সেই রূপকে রহস্যময় করে তুলেছিল জলে ভরা মেঘ। পুরো জায়গাটাই যেন অনবদ্য হয়ে উঠেছিল। আমরা সেখানে পাখির গান শুনতে পাচ্ছিলাম, আজকাল তো পাখির ডাক প্রায় শোনাই যায় না।
কুমায়ুনের একেবারে নিজস্ব খাবার দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হয়েছিল, এর মধ্যে ছিল পাহাড়ের জংলি কাঠ কেটে এনে সারা রাত ধরে রান্না করা ডাল। আমরা যখন হাতায় বসেছিলাম তখন দেখলাম সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে পাহাড়ের কোলে, তখন আমাদের একটা পানীয় খেতে দেওয়া হল, তার নাম সুরকা – এটা টম্যাটো, গম আর নানারকম জরিবুটি দিয়ে তৈরি।
কুমায়ুনি খবারের আসল বৈশিষ্ট্য হল স্থানীয় জরিবুটি ও ফুল দিয়ে রান্না করা হয়। আমরা যেখানে ছিলাম সেটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা এএস মেহতা বললেন, “এ সব দিয়ে তৈরি খাবারের যে স্বাদ আপনি পাবেন, সেই স্বাদ বাজার থেকে কেনা মশলা দিয়ে রান্না করা খাবারে আপনি পাবেন না। কোনও ফুল ও জরিবটি সুরকায় মেশানোর আগে বা রান্নায় দেওয়ার আগে আমরা রাঁধুনিকে বলি সেটি খেয়ে দেখাতে, তা তিনি যাই রান্না করুন না কেন।”
এই হোম স্টে-তে আমরা পাহাড়ের অনাবিল সৌন্দর্য্য উপভোগ করেছিলাম। (ছবি: হিমাংশু শেখর)
ঠান্ডা বাতাস সেই পরিবেশকে আরও সুন্দর করে তোলে, আমরা আলোচনা করছিলাম যে সোশ্যাল মিডিয়া ও নেটফ্লিক্স থেকে দূরে সরে গিয়ে কী ভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়া যায়। এ কথা বলাই বাহুল্য যে সেই একাকিত্ব, প্রকৃতির নিটোল সৌন্দর্য এবং কুমায়ুনি খাবার ও পাহাড়ি ক্ষীর (এটা দুধ-চিনি ও চাল দিয়ে বানানো) আমাকে কতটা মোহিত করেছিল।
কুমায়ুনের নিজস্ব খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতাই আলাদা (ছবি: হিমাংশু শেখর)
বলা হয় যে লেখার জন্য প্রকৃতির বুকে সময় কাটানো একান্ত দরকার, যতই হোক বন্ডও তো একবার বলেছিলেন, “লিখতে লিখতে কখন যে ঘুমিয় পড়লাম।”
(সৌজন্য মেল টুডে)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে