প্রতিবন্ধকতা-সম্পন্ন কোনও নারী কি মা হতে পারেন না? এক লড়াইয়ের কথা
স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন
- Total Shares
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এক বহুতল আবাসনের একটি ১২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে স্বামী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে সংসার জিজা ঘোষের। মায়ের দেওয়া নাম জিজাবাই ঘোষ, তবে তাঁর নিজের পছন্দ শুধুই জিজা।
অনেক সময় বহু দৈনিকে দেখা গেছে লেখা হয়েছে জিজা ঘোষের প্রতিবন্ধকতার কথা। এই কথাটিকে একেবারে ভুল প্রমাণিত করে আমার প্রিয় জিজাদি। তিনি তাঁর প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেছেন এবং একের পর এক নজিরবিহীন উদাহরণ স্থাপন করেছেন সমাজের কাছে, যা থেকে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী মানুষই নন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
জিজাদির জন্ম যে চিকিৎসকের হাতে হয়েছিল, সেই চিকিৎসকের এক ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ছোট্ট জিজার মস্তিষ্কে কিছুক্ষণের জন্য অক্সিজেন পৌঁছতে পারেনি, যার ফলে তিনি সেরিব্রাল পালসির মতো একটি দূরারোগ্য সমস্যায় আক্রান্ত হন। এখানে তাঁর জীবনের বিবরণী দিতে চাই না বরং লেখার মাধ্যমে আমি জিজাদির জীবনের এখনও পর্যন্ত সব কটা লড়াইয়ের মধ্যে সব চেয়ে কঠিন আবার একই সঙ্গে সুন্দর একটা লড়াইয়ের কথা বলব আপনাদের। অবাক হচ্ছেন লড়াই তাও আবার কঠিন অথচ সুন্দর। লেখাটা পুরোটা না পড়লে বোধহয় বুঝতে পারবেন না আমি কী বলছি।
মা জিজার কোলে ছোট্ট হিয়া
জিজার হিয়াকে পাওয়ার লড়াই। সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিবন্ধীদের জীবনকে নিয়ে নানা ভাবনা-চিন্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমাজের ভাষায় সম্পূর্ণ নারীত্ব লাভ করল জিজাদি। ২০১৩ সালে তিনি বিয়ে করলেন তাঁর বহুদিনের বন্ধু বাপ্পাদিত্য নাগকে। বিয়ের পরে জিজাকে প্রথম যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল সেই প্রশ্নটা অতি বড় শান্তিশিষ্ট নারীর সহনশীলতার বাঁধ ভেঙে দেবে। প্রশ্ন করা হয় তাঁর যৌন জীবন নিয়ে। সহজাত অভিব্যক্তি সঙ্গে কিছুটা তাচ্ছিল্য জুড়ে দিয়ে প্রশ্নটিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় জিজাদি। বিবাহিত জীবনে নিয়ে বিভিন্ন হাসি-ঠাট্টা তাঁর কানে আসত কিন্তু খুব মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে তিনি সব দূরে সরিয়ে দিতেন।
বিয়ের দিন জিজা এবং স্বামী বাপ্পাদিত্য
কয়েকবছর এ ভাবেই কেটে গেল। এ বার জিজাদির মনে দানা বাঁধল এক নতুন স্বপ্ন - মাতৃত্বের স্বাদ পেতে সে মরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। তাই স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। একটি সংস্থায় তাঁরা যোগাযোগ করেন এবং যাবতীয় নথিও জমা করেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত এপ্রিল মাসে পাশের টেবিল থেকে একটু জড়ানো উচ্চারণে জিজা দি আমাকে বলেন "এখুনি দত্তক সংস্থা থেকে ফোন এসেছিল আমাদের ওড়িশা যেতে হবে।" আনন্দ সামলাতে না পেরে আমি আমার হুইল চেয়ার জিজাদির পাশে নিয়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। আমাদের দু’জনেরই মনে হয়েছিল যে জিজাদির প্রতিবন্ধকতা শিশু দত্তক নেওয়ার পথে একটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ আমার এখনও মনে আছে অ্যাডপশন সংস্থার একজন আধিকারিক তো জিজ্ঞেস করেই বসলেন যে "সেরিব্রাল পলসি ছোঁয়াচে নয় তো?"
স্বামীর সঙ্গে ছুটির মেজাজে জিজা
তখনও তিনি খুব শান্ত ভাবেই আধিকারিকদের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। কিন্তু তারপর যা ঘটল তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট যদিও লেখা ছিল যে দত্তক পাওয়ার জন্য জিজা ঘোষ মানসিক ও শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ, কিন্তু তাঁরা প্রশ্ন করে বসলেন জিজা ঘোষকে কী সত্যি শারীরিক ভাবে সুস্থ বলা যায়? ইনি তো স্পষ্ট করে কথাটাই বলতে পারেন না, তা হলে নিজের সন্তানের সঙ্গে কথা বলবেন কী ভাবে? এবার জিজা দি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না, তিনি টেবিল চাপড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং স্পষ্ট ভাবে ইংরেজিতে এই আধিকারিককে জিজ্ঞেস করলেন "হোয়াট ইজ ইয়োর কোয়ালিফিকেশন? আর ইউ অ্যান এমএসডাবলু? সে বারই ছোট হিয়াকে বাড়ি নিয়ে আসার কথাও ছিল। কিন্তু আধিকারিকদের প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার ফলে আরও এক মাস কেটে গেল।
২০১৬ সালে প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন মানুষের অধিকার আইন ২০১৬ বা Rights of Persons with Disabilities (RPWD) Act, 2016 অনুযায়ী ওই সংস্থার আধিকারিকরা জিজা ও বাপ্পাদিত্যকে শিশু দত্তক নেওয়া থেকে আটকাতে পারেন না বুঝতে পেরে এবার তাঁরা ফিকির তুললেন যে যে সব দরকারি নথি চাওয়া হয়েছিল তা জমা পড়েনি। সংস্থাটির শেষ রক্ষাও হল না, কারণ বাপ্পাদা একটি ব্যাঙ্কের একজন লিগ্যাল আধিকারিক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন।
সহকর্মীদের সঙ্গে জিজা ঘোষ
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ছোট্ট হিয়া মা জিজাদির কোল আলো করে বাড়ি এল। জিজাদি একজন দক্ষ মা হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রমাণ করে ফেলেছে। হিয়া প্রথম তার মায়ের ডাকে সাড়া দিয়েই তার মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল হামাগুড়ি দিয়ে। তাই এমন একজন নারীকে কী আমরা তাঁর প্রতিবন্ধকতা বা রূপের মাপকাঠিতে বিচার করতে পারি? কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটাই বা অস্বাভাবিক সেটা কে ঠিক করবে? আপাতদৃষ্টিতে যাঁকে দেখলে খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে, আসলে তাঁর ভাবনাচিন্তাটা হয়তো বেশ অস্বাভাবিক বা জটিল। আবার একজন প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন মানুষ এমন কিছু করার কথা ভাবছেন যা আমাদের সব্বাইকে তাকে লাগিয়ে দিতে পারে। প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন মানুষকে কী স্বপ্ন দেখতে নেই?