একদল পুলিশ আধিকারিক যখন সোশ্যাল মিডিয়ার তৈরি উন্মত্ততার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়
এই আইপিএস আধিকারিক লিখছেন ডিজিটাল-অজ্ঞতার ভয়াবহতা সম্পর্কে
- Total Shares
আমাদের চারদিকের পৃথিবী বদলে যাচ্ছে আর সেটাই অবশ্যম্ভাবী। যদি বিবর্তনবাদ থেকে আমরা কিছুমাত্র শিখে থাকি, তা হলে সেটি হল সময়ের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তবে কয়েকটি ঘটনা আবার স্বতঃস্ফূর্ত নয়, তা ঘটানো হচ্ছে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করে – যা মানবতার পক্ষে অভিপ্রেত এমন পরিস্থিতি থেকে বহু যোজন দূরে।
আমরা অবচেতন ভাবেই প্রযুক্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছি মানুষকে শিকার বানানোর জন্য।
মানুষের অতিমাত্রার আকাঙ্ক্ষার সামনে আমরা যা সৃষ্টি করেছি তার দায়িত্ব নিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কোনও কিছুর মধ্যে যে মহান সম্ভাবনা থাকে, প্রযুক্তি সব সময় সেই দিকে ধাবিত হয় না – অনেক সময় আমাদের জৈবিক উন্মাদনাকেও তা প্রভাবিত করে।
আমি এই বেদনাদায়ক বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছি ২০১৮ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে যখন তেলঙ্গনা অঞ্চলের দক্ষিণাংশে জগুলাম্বা-গাড়োয়াল জেলায় জেলা পুলিশের প্রধান রূপে কাজ করছিলাম।
ছেলেধরা বলে মনে করে অসমের কার্বি আংলঙে দুজনকে গণপ্রহারের প্রতিবাদে গুয়াহাটিতে মিছিল। (ছবি: পিটিআই)
আইনের প্রয়োগকর্তা হিসাবে, আমরা সকলেই খুব ভালো ভাবে একটা বিষয় জানি যে, কোনও লোক কেন অপরাধ করছে তা আন্দাজ করার মতো কোনও স্বতঃসিদ্ধ পন্থা নেই। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি যে আপাতভাবে অতি সাধারণ ও নিরীহ মানুষও ভয়ানক অপরাধমূলক কাজ করে ফেলছেন। এবার এর সঙ্গে প্রযুক্তি জুড়ে দিন এবং তার সঙ্গে জুড়ে দিন অনুমান না করতে পারা – তা হলে বুঝুন এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কঠিন হয়ে পড়ে।
এই সমস্যাটা যে আমি আচমকা অনুধাবন করতে পেরেছি তা নয়।
২০১৮ সালের গ্রীষ্মেও আমাদের অপরাধের যে মূল তালিকা (ক্রাইম হেডস) তাতে সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও জায়গাই ছিল না। আর গণপ্রহারের ঘটনাও রাজ্যের এই অঞ্চলে অজানাই ছিল। পুলিশের যা দৈনন্দিন কাজ সে সব নিয়েই আমরা থাকতাম। আমি যথন ‘গ্রামীণ পুলিশ আধিকারিক’দের (কনস্টেবল আধিকারিকরাই গ্রামাঞ্চলে ও গ্রামের বিভিন্ন ক্লাস্টারে তৃণমূল স্তরের চৌকিদারি কাজকর্ম করেন, তারা বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেন) সঙ্গে সাপ্তাহিক রিভিউ মিটিং করছি, তখন একজন আধিকারিক তাঁর একটা অভিজ্ঞতার কথা জানালেন – তিনি এমন একটা ঘটনার কথা জানালেন যা উষ্ণ ও রুক্ষ গ্রামাঞ্চলে আগে কোনও দিন ঘটতে দেখা যায়নি।
সেই সপ্তাহে তিনি যে চারটি গ্রাম পরিদর্শন করেছেন সেখানে রাত নামলেই লোকে ঘরের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে – মার্চের সেই ঘর্মাক্ত গরমে সেটা বেশ আশ্চর্যজনক ছিল। এই সব এলাকায় পরিবারগুলো বড় হলেও ঘরগুলো ছোট ছোট। গ্রামের দিকে গরমকালে প্রত্যেকেই ঘরের বাইরে শুতে পছন্দ করেন। এই অভিজ্ঞ পুলিশকর্মীর দৃষ্টিতে সেই ব্যাপারটি বেশ আশ্চর্যজনক বলে ঠেকেছিল।
আমি তাঁর কাছে পুরো ঘটনা শোনার পরে ঠিক করলাম যে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশ আধিকারিকদের পাঠিয়ে জানতে চাইব কেন তাঁরা এত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
পুলিশ আধিকারিকরা আরও একটা অত্যাশ্চার্য রিপোর্ট নিয়ে এলেন – স্থানীয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তাঁরা একটি ভিডিয়ো দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন, কয়েকটি ছবি ও কণ্ঠস্বর সম্বলিত ওই ভিডিয়ো একটি ভয়ানক অপরাধীদলের – যার নাম পার্থি।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে একই রকম একটি ছেলেধরার গুজবে পাঁচজনকে গণপ্রহার করে হত্যা করা হয়েছিল (ছবি: এএনআই)
উনিশ শতকে ফিরে চলুন, পার্থিরা ছিল অত্যন্ত দক্ষ শিকারী এবং ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের পরে তারা ব্রিটিশদের কাছে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই দুর্দান্ত উপজাতিকে আয়ত্তে রাখার জন্য ব্রিটিশরা তাদের ক্রিমিন্যাল ট্রাইবস অ্যাক্ট ১৮৭১–এর অধীনে নিয়ে আসে। যদিও ১৯৫২ সালে আইন করে এই উপজাতিদের সেই আইনের আওতা থেকে বার করে আনা হয়, তা সত্ত্বেও তাদের নতুন করে তকমা যাযাবর উপজাতির তকমা দিয়ে দেওয়া হয়, তবে লোকের মনে এখনও তাঁদের ব্যাপারে সেই পুরোনো ধারনাই রয়ে গেছে, লোকে এখনও তাদের বিষদৃষ্টিতেই দেখে থাকে এবং তাদের প্রতি সেই ভ্রান্ত দারনাই পোষণ করে যাচ্ছে। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে এখনও এই জনজাতির কোনও কোনও সদস্য অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
একজন লোকের শরীর ছিন্নভিন্ন করে চারজন লোক তাঁর শরীরের ভিতর থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বার করে আনছে-- রক্তাক্ত সেই ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। এটা আসলে কম্পিউটারের কারিকুরির মাধ্যমে করা মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বার করার ছবি, যেটি পার্থিদের বলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এটি একেবারে গণ হিস্টিরিয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল।
সন্ধ্যা ৬টার পর পর কেউই আর ঘরের বাইরে বেরচ্ছিলেন না। ছোটদের খেলতে যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। যে সব মহিলাকে খুব ভোরে কাজে বেরতে হয় তিনি সঙ্গে একজন কাভালকারকে (রক্ষী) নিয়ে যাচ্ছিলেন। গণপিটুতে মৃত্যুর ভয়ে ভিখারিরা পর্যন্ত পালিয়ে যাচ্ছিলেন। আতঙ্ক এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যে পুলিশকে কন্ট্রোলরুম খুলতে হয়েছিল।
আত্মীয় ও পরিবার ও বন্ধুবান্ধব, যাঁরা শুভানুধ্যায়ী ও অন্তরঙ্গ তাঁদের মাধ্যমেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ায় সকলেই সেই কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন এবং আতঙ্কের পারদ ক্রমেই চড়ছিল।
সর্বজনীন আতঙ্ক লোকজনকে অতন্দ্র করে দিয়েছিল।
প্রাথমিক ভাবে আমরা বুঝেই উঠতে পারিনি যে কী ঘটে চলেছে – কিন্তু যখনই আমরা বুঝলাম যে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চুপিসারে গুজবের বেশে বিপদ ঢুকে পড়ছে এবং তা হিংসায় ইন্ধন জোগাচ্ছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে বিট ও গ্রামীণ পুলিশ আধিকারিকদের জরুরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আমরা করি।
মিথ্যা খবর সম্বন্ধে তাদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ছড়ায় সেগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা যে প্রায় নেই, সেই কথাও বলা হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে কোথায় কোথায় এই ধরনের উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি তার একটা মানচিত্র তৈরি করি।
আধিকারিকরা ৪০০ জন গ্রামবাসীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে ভালোমতো পাঠ দেন এবং সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে নিয়মকানুন ও আত্ম-নিযন্ত্রণের পাঠও দেন – এবং আইন নিজেদের হাতে তুলে নিলে কী হতে পারে সেই পাঠও দেন গ্রামবাসীদের।
কর্নাটকের বিদরে ছেলেধরা গুজবে যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ আজমকে গণপিটুনির শিকার হতে হয়। (ছবি: রয়টার্স)
আন্তর্জাতিক সনম্যার স্থানীয় প্রতিকার খোঁজার যে চেষ্টা আমরা করেছি, আমরা ঘোষক নিযুক্ত করেছি, স্থানীয় ভাবে যাঁদের বলা হয় দাপ্পু শিল্পী – এবং আমাদের বার্তা গ্রামের লোকজনের কাছে কী ভাবে পৌঁছে দিতে হবে সে ব্যাপারে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
মাত্র তিন মাসের মধ্যে এমন ২৩টি ঘটনা ঘটেছিল যেখানে গ্রামের জনতা উন্মত্ত হয়ে লাঠি হাতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির উপরে চড়াও হয়েছিল। গ্রামে কোনও বহিরাগতর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছিল। গ্রামের সকলেই ‘ওদের’ ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন।
এ সবের মধ্যেই আমরা অনলাইনের পাশাপাশি মেঠো লড়াইও লড়ছিলাম। এলাকার লোকজনের মধ্যে যে সব ভিডিয়ো চালাচালি হয় সেগুলির কোনটির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় নেই সে সবের উপরে নজর রাখছিলেন প্রযুক্তি বোঝেন এমন কয়েকজন আধিকারিক, বিশেষ করে বিদ্বেষ ছড়ায় এমন বার্তা এবং হিংসাত্মক ভিডিয়োর উপরে। যখনই তাঁদের চোখে এমন কিছু তখনই তাঁরা অ্যাডমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে সব মুছে দিয়েছেন।
গ্রামের পঞ্চায়েতপ্রধান ও গ্রুপ-অ্যাডমিনদের মতামত নিয়ে কয়েকজন স্থানীয় পুলিশ আধিকারিকও বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিজেদের অ্যাড করে নেন এবং গ্রুপের সদস্যদের প্রশিক্ষিত করতে থাকেন যাতে তাঁরা ভিত্তিহীন মেসেজ এবং ভিত্তিহীন ও প্রযুক্তির কারিকুরিতে বানানো ভিডিয়োগুলি ফরওয়ার্ড না করেন।
গত বছরের মে-জুন মাস নাগাদ আমরা দেখতে পাই দের বিভিন্ন প্রান্তে গণপ্রহার নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর পরিবেশিত হচ্ছে। সে যাই হোক, মূল দায়িত্ব ও নিত্যদিনের কাজের বাইরে জোগুলাম্বা গাড়ওয়াল জেলায় প্রত্যেক পুলিশ আধিকারিই প্রত্যেক দিন নিয়ম করে কয়েক ঘণ্টা কাটাতেন, যাঁরা লেখাপড়া জানেন না মূলত তাঁদের কাছে গিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া গণপ্রহারের গুজব সম্বন্ধে সচেতন করতেন।
হোয়াটসঅ্যাপ এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি আমাদের জ্ঞানের বিবর্তনের গতি মন্দীভূত করছে। (ছবি: রয়টার্স)
এরই মধ্যে করাচিতে বিকৃত করা একটি ভিডিয়ো ছড়িযে পড়ে গ্রামে এবং ছেলেধরার গুজবে ইন্ধন জোগায় যা হিংসার আকার নেয়।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে কথাবার্তা এবং অসংখ্যবার বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে কথোপকথন আমাদের আশ্চর্জনক একটা দিক খুলে দিয়েছিল এবং সম্ভবত এক বছরের মধ্যে সেটাই ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে গতবছর আমাদের কাছে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
আমরা যতটা ভেবেছিলাম ইন্টারনেটের ব্যবহার তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল – যে সব লোকজন লিখতে বা পড়তে পারেন না তাঁরাও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন। ধ্যানধারণা কম থাকার সুবাদেই ভয়ানক সব ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ছিল। বুদ্ধি দিয়ে কোনও কিছু বিচার-বিবেচনা করার চেয়ে সে সব লোকে বিশ্বাস করে নিচ্ছিলেন এবং তার জেরেই আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছিল।
একটা ব্যাপার প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে আমরা যে সব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি সেই সব সমস্যার সমাধান প্রথাগত পুলিশি কায়দায় করা সম্ভব হবে না। তাই আমরা সমাজ-সচেতনতার মাধ্যমে লোকজনকে প্রশিক্ষিত করার উপরে জোর দিতে শুরু করি, যাকে বলে ‘ফোকাসড ডেটারেন্স’।
যে কোনও ব্যাপারে আমাদের তৎপরতা ছিল ছোট এলাকাভিত্তিক এবং অত্যন্ত দ্রুত। কারা সমস্যা তৈরি করতে পারে তাদের চিহ্নিত করা, যে সব ঘটনা থেকে সমস্যা তৈরি হতে পারে সেগুলিকে চিহ্নিত করা, কোথায় কোথায় ইন্টারনেটের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি সেই সব জায়গা চিহ্নিত করা, কোথায় কোথায় সাম্প্রদায়িক সংবেদনশীলতা বেশি এবং আগের রাজনৈতিক বিভাজনের ইতিহাস সংগ্রহ করতে শুরু করি আর যে সব গ্রামে জনঘনত্ব বেশি সেকানের তরুণদের এর অংশ করে নিই।
এ ছাড়াও যারা আইন ভঙ্গ করছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নির্দিষ্ট লোকজনের সঙ্গে বৈঠক – যেখানে আমরা সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতাম যে কী ভাবে আমরা ভুয়ো খবরের জেরে ছড়িয়ে পড়া ভীতি থেকে সকলকে বার করে আনার নিদারুণ প্রচেষ্টা করে চলেছি – এটাই ছিল আমাদের ‘ফোকাসড ডেটারেন্স’-এর ধরণ।
সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া গিয়েছিল যে কৌশল থেকে সেটি হল আমাদের পুলিশের সাংস্কৃতিক বিভাগের উদ্যোগে করা গ্রাম-ভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুলিশকর্মীদের মধ্যে গ্রামবাসীদের গান ও নাচ শেখাতে পারতেন এবং তাঁরা তাঁদেরও নাচগান শিখিয়েও ছিলেন, গ্রামীণ ভাষা ও উচ্চারণে লেখা কথায় গাওয়া লোকগীতিই গুজবের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়েছিল।
We use #Storytelling to establish a Connect with communities‘Police Cultural Troupe’ has done amazingly well to demonstrate how civic education revolutionises Police-Community relations and brings about legal awareness in remote villages. Team is seen in Moosapet #ChildSafety pic.twitter.com/ly9fk5Od0l
— Rema Rajeshwari IPS (@rama_rajeswari) 6 February 2019
প্রশ্ন হল আমা গ্রামে গ্রামে বার্তা ছড়ানোর জন্য এই সব পুরনো পন্থার (ঘোষক) আশ্রয় কেন নিলাম এবং কেন স্থানীয় কথকতার রীতি গ্রহণ করেছিলাম, উত্তর হল, গ্রামের মানুষজন নিজেদের অজান্তেই ভিতরে ভিতরে ভীষণ ভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা কেউই দাগী অপরাধী নন – তাঁরা সাধারণ লোকজন ছিলেন যাঁরা আত্মরক্ষার জন্য এবং নিজেদের সন্তান ও আপনজনদের রক্ষা করার জন্য অপরাধী হয়ে উঠছিলেন।
একের পর এক সরকার তাঁদের হাতের মুঠোয় প্রযুক্তি এনে দিয়েছেন কিন্তু ডিজিটাল লিটারেসি সম্পর্কে তাঁদের শিক্ষিত করার কাজ কেউই করেননি।
মানুষের সবচেয়ে প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য – যখনই আমরা জৈবিক ক্রিয়ার মাধ্যমে বুঝতে পারি যে কোনও বিপদ আসতে চলেছে তখনই আমরা হিংস্র হয়ে উঠি, এই বৈশিষ্ট্যটি একেবারেই চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়াই আমাদের এই ঘোড়ায় টান দিয়েছিল এবং মানুষের স্বতঃপ্রতিরক্ষার কৌশল জেগে উঠেছিল, তাতেই লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিলেন, যার ফল হল গণ-উন্মত্ততা।
আমার মতে, এটাই হল গণপ্রহারের প্রাথমিক কারণ, যখনই বহিরাগতদের সম্পর্কে বা সমাজের কোনও নির্দিষ্ট অংশ সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়া কোনও ইন্ধন জোগায় তখনই তা জ্বলে ওঠে। গণপ্রহার হল ক্রোধে প্রবৃত্ত হয়ে মারাত্মক ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা, এ ছাড়া অন্য কিছু নয়। ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের সামজিক বিভেদ-বিভাজন এবং এক গোষ্ঠী সম্পর্কে অন্য গোষ্ঠীর চিরাচরিত কিছু ধ্যানসধারনা রয়েছে তাই ভারত খুবই স্পর্শকাতর – এই দুর্বল অংশে আঘাত হানার উপযুক্ত মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে সোশ্যাল মিডিয়া।
ভারতের জনসংখ্যার বড় অংশই গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী আর তাঁদের কোনও কিছু বুঝিয়ে দেওয়া অত্যন্ত সহজ ব্যাপার, তার কারণ তাঁরা অবহেলিত ও অশিক্ষিত।
সচেতনতার প্রসারে রাজেশ্বরী। (ছবি: রয়টার্স)
হিংসা ছড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে ভুয়ো খবরের, এই ধরনের খবর শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, শুধুমাত্র পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলরে ক্ষমতাই নয়, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সৌভাতৃত্ব বিনষ্ট করার ক্ষমতাও তার রয়েছে। কখনও নামগোত্রহীন কোনও কিছু একটা ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তার থেকেই ভয়ানক সব ব্যাপার ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।
সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের একটা সুযোগ দিয়েছে, তা হল পরিচয় গোপন রেখে কোনও কিছু বলা। বেশিরভাগ লোকই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন একটা উঠতি ব্যাপার বলে, আর এই জন্যই তাঁদের অজ্ঞানতা ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে।
এই সমস্যা দূর করতে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে এর সঙ্গে যুক্ত করে সুবিশাল গণ-কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মাত্রাছাড়া ভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এর প্রভাব কী হতে পারে বা এর জন্য সাধারণ নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনে কী মূল্য চোকাতে হতে পারে সে কথা বিচার-বিবেচনা না করেই।
ডিজিটাল-শিক্ষার প্রসারে আন্তরিক ভাবে সচেষ্ট হওয়া জরুরি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখেছি যেখানে পরিসংখ্যান-সর্বস্ব বাণিজ্যিক মডেল কী ভাবে সর্বাত্মক উদার গণতন্ত্রকে অবদমিত করেছে।
গণতন্ত্রে ভিত্তি ও আবশ্যিক কথা হল জনগণ। ডিজিটাল বিবর্তনের বৈচিত্র্যের দিকে বেশি নজর না দিয়ে এখন ভিতটাকে শক্ত করার দিকে নজর দিতে হবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে