কী ভাবে আমি বুঝলাম ভালোবাসা কারে কয়?
ভালোবাসা হল মায়ের মমতামাখা গোলাপের গন্ধমাখা সেই ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত
- Total Shares
গত ১৮ বছরে এই প্রথম বার আমার একমাত্র ছেলে মুসা বছরের শেষ দিনে বাড়ির থেকে দূরে ছিল। অনেক দূরে ছিল, ভীষণ ঠান্ডার মধ্যে সে চকচকে পোশাকে নিজেকে মুড়ে বন্ধুদের সঙ্গে বড়দিনের আনন্দে মেতেছিল নিউ ইয়র্কে, পড়াশোনার প্রবল চাপ থেকে মুক্ত হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে গিয়েছে, আমার ১৮ বছরের ছেলে খুশিতে ডগমগ, সে এখন আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছে আর প্রতিদিন সে যখনই আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে তখনই ও আমাকে হাসায়। আর যখন আমি প্রতিটি মুহূর্তে ওর নিঃসঙ্গতা অনুভব করি তখন একটা কথা মাথায় রাখি যে ঘর ছেড়ে গেলেও ঘরে থাকার মতো আনন্দেই রয়েছে: নিউ ইয়র্ক সিটিতে ওর কলেজের ডর্মিটরিতে ও রয়েছে।
জীবন এই রকমই। এমন অনেক কিছু রয়েছে যা আপনার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বাইরে, আপনার ধ্যানধারনার অতীত, আপনার পদমর্যাদার উপরে নির্ভর করে না, যার আগে পরে কিছু বলে বা অন্য কোনও ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এখানেই অন্য কাউকে দেখে একটা অনুভূতি বা সম্পূর্ণতা অনুভব করতে পারেন, আচমকা কোনও সম্পর্কের কথা আপনার মনে পড়ে যাওয়ার মনের মধ্যে অদ্ভুত অনুভূতি হতে পারে, কোনও সম্পর্ক নতুন একটা মাত্রা পেতে পারে আপনার সেই ভালোবাসার অনুভূতির মধ্য দিয়ে আর সেই অনুভূতির মধ্য দিয়েই নতুন এক বাঁধন তৈরি হতে পারে। আপনি আপনিই। কিন্তু তার বাইরেও আপনার ভিতরে একটা সত্ত্বা রয়েছে।
আপনার এই সত্ত্বার নেপথ্যে ওরা আছে। আমার এই সত্ত্বার নেপথ্যে রয়েছে আমার সন্তান। নাকি ঠিক এর উল্টোটা? মানে আমার ছেলের সত্ত্বার নেপথ্য আমি রয়েছি? একজনের প্রতি একজনের যে ভালোবাসার বন্ধন তার সেই নিগূঢ় রহস্য কোনও একটা প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া সম্ভব নয়। যেমন কেন সেই ভালোবাসা অন্য কারও উপরে আরও বেশি করে বা একটু কম হলেও গিয়ে পড়ে বা অন্য ভাবে তা প্রকাশিত হয়, সেই প্রশ্নেরও এক কথায় কোনও উত্তর নেই। যেটা বোঝা খুব কঠিন তা হল আমরা যদি একটা কাচের সঙ্গে তুলনা করে এর সংজ্ঞা নিরুপণ করার চেষ্টা করি তা হলে কেন সেই ভালোবাসা এক পলকা, এত জটিল, আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বদলাতে থাকে, কখনও তার মধ্যে কাঠিন্য দেখা যায়, কখনও বা তা আরও নরম হয়ে যায়, কেন তা দ্রুত ভেঙে যেতে পারে বা ভাঙার জন্য যেন প্রস্তুত হয়েই থাকে? আমরা এই প্রশ্নের উত্তর জানি না।
এমন অনেক কিছু রয়েছে যা আপনার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উপরে নির্ভর করে না (ছবি: রয়টার্স)
মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই পরিবর্তন ঘটতে থাকে তাতে আমি কেমন ভাবে আছি, তুমি কেমন ভাবে আছ, আমরা কেমন ভাবে রয়েছি, ওরা কেমন ভাবে রয়েছে তার উপরে এই পরিবর্তন নির্ভর করে না বরং নির্ভর করে আমাদের জীবনে ঘটনা কয়েকটা উদ্ভট ও আপাত ভাবে ছোট ঘটনার উপরে। আপনি দখছেন যে আপনার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, আপনি দিন আনেন দিন খান, আপনার চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে, ঘুমের ঘোরে আপনি হাঁটতে থাকেন, একদিন প্রতিদিন। প্রতিটি পদক্ষেপেই পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়, প্রতিটি দিনই চোখ খোলার সঙ্গেই মিথ্যা আশা দানা বাঁধে, অনেক কিছু করার আছে কিন্তু লাভ কিছুই হয় না। জীবন সেটাই যেখানে দুঃখ আছে, জীবন সেটাই যেখান থেকে আচমকা কিছু চলে যায়, জীবন সেটাই যেখানে হতাশা আছে, জীবন সেটাই যেখানে তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে কেউ ছুরিকাঘাত করে, জীবন আপনাকে আপনার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে, জীবন মানে সেটাই যা আপনাকে মিথ্যা আশার আলো দেখিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, জীবন সেটাই যা আপনাকে প্রলুব্ধ করে, ভ্রষ্ট করে এবং জীবন হল সেটাই যা প্রতারণা করে, যখনই আপনি মনুষ্যত্বের আলো খুঁজবেন তখনই থতমত খাবে, হোঁচট খাবেন এমনকি একাকিত্ব অনুভব করবেন যেন মনে হবে অন্ধকার গ্রাস করছে, খাটের নীচে লুকিয়ে রয়েছে ছোট পা-ওয়ালা ভনায়ক এক দৈত্য। আপনার একটা প্রতিরূপ যেন আলোর ফুলকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনি তা দেখছেন নিঃশব্দে, পুরো অসাড় হয়ে, নড়াচড়া বন্ধ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
ভালোবাসা হল শিশুর মুখের উজ্জ্বল হাসির মতো (ছবি: রয়টার্স)
তখন ক্যাঁ-চ করে শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল, সেখান দিয়েই প্রবেশ করল ভালোবাসা। ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় এটা ঠিক তেমন নয়। এই ভালোবাসা হল শিশুর মুখের উজ্জ্বল সরল হাসি, এই ভালোবাসা হল পোষা কুকুরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আদর করে অপ্রস্তুত করে দেওয়া, কোনও কারণ ছাড়া কোনও তরুণীর অট্টহাসি, ভালোবাসা হল কোনও ভাইঝির সঙ্গে রোজ একবার করে কথা বলা, ভালোবাসা হল প্রিয় বন্ধুকে ভোর চারটের সময় মেসেজ করা, ভালোবাসা হল কাউকে নিজে থেকেই সাহায্য করে যাওয়া এবং কখনও কোনও প্রতিদান না চাওয়া, ভালোবাসা হল একজন পুরুষের উদার হাসি যে হাসির জন্যই তিনি পরিচিত যে হাসি কিছুতেই ফুরোতে চায় না, ভালোবাসা হল বোনের কাছ থেকে প্রত্যেক দিন একবার করে ফোন ফোন আসা এমনকি রাত দুটোর সময়, যখন আপনি গভীর ভাবে ঘুমোচ্ছেন, ভালোবাসা হল রাত একটার সময় ভাইয়ের অর্ধেকটা না খাওয়া চাইনিজ খাবার আপনার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া, ভালোবাসা হল গোলাপের গন্ধ মাখা মায়ের ক্ষণিক স্মৃতি, ভালোবাসা হল সন্তানকে চেপে ধরে আদর করা। ভালোবাসায় কোনও শর্ত থাকে না, যা কিছু ভালো তাই-ই ভালোবাসা, যার মধ্যে অহমিকা নেই সেটাই ভালোবাসা, ভালোবাসা মায়াময়, ভালোবাসা মানে এটুকুই।
এই সব অনুভূতিই আমাদের ঘিরে রয়েছে। তবে আমাদের চারপাশে যা কিছু মন্দ, সে সব নয়, একজন মানুষ যখন অন্যজনের প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে বা কোনও প্রাণীর উপরে বা এই বিশ্বের উপরে, যুদ্ধের ভয়াবহতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র, জরা, ক্ষুধা, সন্ত্রাস, বাস্তুচ্যুতি, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, শিশুকে যৌন নিগ্রহ করা, শিশুকে অন্ধ করে দেওয়া, শিশুকে অনাহারে রাখা, শিশুকে বিকলাঙ্গ করে দেওয়া, তাদের ঘর কেড়ে নেওয়া, মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, আর্তজন, ধর্মীয় বিশ্বাস-জাতপাত-ধর্মান্ধতা-শ্রেণিবিন্যাস-সীমান্ত প্রভৃতির ভিত্তিতে ভেদাভেদ; অকারণ সীমান্ত-বিভেদ, অন্য কোনও কারণে উন্মত্ততা, অবিচার, নিপীড়ন, হেনস্থা, কুৎসিত ভাবে কথা বলা, অসত্য কথা প্রচার করা, দ্বিচারিতা, কোনও মিথ্যা প্রচারে ইন্ধন জোগানো, ঘৃণার জয় এবং ক্ষমতার লোভে কোনও কিছু করা।
ভালোবাসার দৃষ্টিতে সবকিছুই সুন্দর লাগে। (ছবি: রয়টার্স)
ভাঙা ইট-পাথরের টুকরোর মধ্যে দিয়ে সেই ভালোবাসা প্রবেশ করতে পারে – গভীর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সেই ভালোবাসা প্রবেশ করতে পারে, চিৎকাল-চেঁচামেচির মধ্য দিয়ে তা প্রবেশ করতে পারে, অর্থহীন কোনও কিছুর মধ্যেও সেই ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ভালোবাসা কখনও বড়-ছোট বিভেদ মানে না, সে নিজেই তার নিয়ম তৈরি করে নেয়, সে তার নিজের মতো করেই বয়ে চলে। ভালোবাসা হল নিঃশর্ত, ভালোবাসা হল আমিত্বহীন, ভালোবাসা হল সুন্দর, ভালোবাসা হল বিনয় যা এই বিশ্বে মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখে বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাত থেকে, এবং ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখে স্বপ্ন আর কল্পনাকে।
ভালোবাসাই বাঁচিয়ে রাখে। (ছবি: রয়টার্স)
যাঁরা প্রতি মুহর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন, যাঁদের বাস্তবিক উপস্থিতি ছাড়া আমরা কোনও কিছু ভাবতেই পারি না, ভালোবাসা তাঁদের জন্য পৃথিবীকে নিজের অক্ষের উপরে আবর্তিত করে চলেছে। যাঁদের নিজেদের অন্তরে ভালোবাসা নিহিত রয়েছে তাঁরাই বিনয়ী হন, যাঁরা নরক থেকে কাউকে উদ্ধার করে জীবনের পথে ফেরাচ্ছেন রক্ত দিয়ে, বন্ধুত্ব দিয়ে, নির্ভরতা দিয়ে এবং মনুষ্যত্ব দিয়ে তাঁরাই ভালোবাসায় বিশ্বাসী। যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা বিশ্বাস করেন যে কোনও কিছুই অনমনীয় হয়, যাঁরা ভালোবাসেন তাংরা বিশ্বাস করেন ধ্বংস শাশ্বত নয়, যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা মনে করেন দূরত্ব মানেই অনুপস্থিতি নয়। যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা মনে করেন মৃত্যুতে সব ভালোবাসা শেষ হয়ে যায় না। যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা বেঁচে থাকেন।
আমি যখন লাহোরে বসে এই লেখাটা লিখছিলাম তখন ডিসেম্বর মাস, তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস, আমার দুই প্রিয়জন পার্ল ও সামারের নাকডাকার শব্দ নিঃস্তব্ধতা বিঘ্নিত করছে, কুয়াশায়-ঢাকা জানলার কাচ দিয়ে দেখছি বছরের শেষ দিনের আগের দিন শান্ত অবসন্ন আবছা নীল আলো, আমার ছেলের মজার কথাগুলো মনে পড়তে হাসি পেয়ে গেল। মুশার সেই হাসির কথাগুলো আসলে ভালোবাসা। মুশার হাসির কথাগুলোই হল জীবন।
যাঁরা ভালোবাসেন ও বেঁচে থাকেন তাঁদের সকলকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
তাঁদের শুভেচ্ছা যাঁরা একদিন ভালোবাসবেন আর বাঁচতে শিখবেন...
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে