ঈদের সময় বাংলাদেশে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, কারণ কী?
সৈয়দপুর উপজেলায় বাসের ধাক্কায় ৯ জন পিকআপ আরোহী নিহত হয়েছেন রবিবার রাতে
- Total Shares
এ বছর ঈদে গত তিন দিনে সারাদেশে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৩৫, আহত হয়েছেন পাঁচশোরও বেশি। এই সংখ্যাটি কেবল গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের তথ্য। এর বাইরেও আছে প্রাণহানির ঘটনা।
বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলায় বাসের ধাক্কায় ৯ জন পিকআপ আরোহী নিহত হয়েছেন রবিবার রাতে। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১২ জন। প্রতিবছর ঈদ এলেই এই ধরনের বড় বড় দুর্ঘটনা যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে।
ঈদে বাড়ি আর কর্মস্থলে ফেরা মানুষের স্রোত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সড়কে বাড়ে দুর্ঘটনা, বাড়ে মৃত্যুর সংখ্যা। বাংলাদেশে ঈদ এলেই বেড়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনা। বাড়ে মৃত্যু আর আহতের সংখ্যা। ফলে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে কারও কারও পরিবারে নেমে আসে শোক।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে নেই এমন দিন পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে ঈদের আগে ও পরে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ে কয়েকগুণ।
কেন এই মৃত্যু? এ জন্য কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন সড়ক বিশেষজ্ঞরা। নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে চালক-মালিকদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, গেল বছর ঈদ–উল-ফিতরের আগে পরে ১৫ দিনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় ১৯০ জন। আর ঈদ-উল-ফিতর আজহারের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় একশ জন।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এর সহকারী অধ্যাপক সাইফুল নেওয়াজ বলেছেন, ঈদের সময় চালকরা কখনও বিশ্রাম পান না, তাঁরা একের পর এক ট্রিপ দেন। তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানের জন্য চালকরা অন্য গাড়ি অতিক্রম করেন। তখন তাঁদের গাড়ির গতি অতিরিক্ত থাকে। এ সব কারণে দুর্ঘটনা বেশি থাকে।
পরিসংখ্যান বলছে, ঈদের সময় সড়ক-মহাসড়কে অসচেতনার কারণে পথচারীরা বেশি মারা যান। চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঘটে মুখোমুখি সংঘর্ষ। এ ছাড়া বেপরোয়া মোটরবাইক চালানো, মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবহন, আর ফিটনেসবিহীন যানও দুর্ঘটনার মূল কারণ।
সড়ক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেছেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাওয়ার সময় নয়তো বাড়ি থেকে আসার সময়ও দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের দুই সময়েই নজরদারি রাখতে হবে।
নিরাপদ ঈদ যাত্রার জন্য কর্তৃপক্ষ আর পরিবহণ মালিক-চালকদের দ্বায়িত্বশীল আচরণ সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
এমন দুর্ঘটনার জন্য অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল, সহকারীদের দিয়ে গাড়ি চালানো এবং যাত্রীদের দ্রুত যাওয়া প্রবণতাকেই দায়ী করছেন দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক মাহবুব আলম তালুকদার। তিনি বলেছেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা সব সময়ই ঘটে। কিন্তু ঈদ এলেই যেন এটি অনেক গুণ বেড়ে যায়। কারণ এই সময়টিতে গাড়িতে মানুষের বাড়তি চাপ থাকে। আর গাড়ি চালকরা অতিরিক্ত রোজগারের আশায় বাড়তি কাজ করতে গিয়ে বিনিদ্র থাকেন। ফলে তাদের তন্দ্রাচ্ছন্নতা মানুষের জীবন কেড়ে নেয়’।
মেহবুব আলম তালুকদার বলেছেন, ‘ঈদের সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। মানুষের মধ্যে দ্রুত চলাচলের প্রবণতা কাজ করে। অবৈধ গাড়ি চলে। বেশি মুনাফার লোভে রোড পারমিটবিহীন গাড়ি চলে। এ সব কারণে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় ঘরমুখী মানুষের ফলে প্রায় ঘটে দুর্ঘটনা।’
ঈদ-উল ফিতরের আগে এবং পরে সড়ক দুর্ঘটনার হিসেব কষে দেখা গেছে, ঈদের আগে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৪৩ শতাংশ। আর ঈদের পরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৯ শতাংশ। আর ঈদের দিন এ দুর্ঘটনার হার ৮ শতাংশ।
সে হিসেবে দেখা যায় ঈদের পরেই সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। ঈদের পরেই কেন সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে - এমন প্রশ্নের জবাবে বুয়েটের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেছেন, ‘ঈদের আগে সড়ক-মহাসড়ক ব্যবস্থাপনায় যেরকম উদ্যোগ নেওয়া হয়, ঈদের পরে সেটি শিথিল হয়ে যায়। আরেকটি বড় সমস্যা হল, ঈরে পরে বিভিন্ন জেলা স্তর থেকে মানুষ শহরে আসতে থাকেন। সেখানে কিন্তু কোনও নজরদারি থাকে না। ফলে সড়কে দুর্ঘটনা বেশি হয়।’
এই সমস্যা থেকে উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ঈদের সময় আইন যেন লাইসেন্স বিহীন কোনও চালক গাড়ি চালাতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অবৈধ গাড়িগুলো যেন সড়কে চলতে না পারে।
অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেছেন, দুর্ঘটনাকবলিত মানুষকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাও জরুরি। হাসপাতালে এই ধরনের রোগীর চিকিৎসার জন্য ট্রমা বিশেষজ্ঞ থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা যেমন- চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, বরিশাল, লালমনিরহাট-সহ বিভিন্ন জায়গায় মেডিক্যাল টিম থাকতে হবে। মহাসড়কে নসিমন, করিমন ও ভটভটি যেন না চলে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ করতে হবে। কারণ ওভারটেকিং করতে গিয়ে এ সব যানবাহনের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
চালকরা যাতে আট ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালান, সেদিকে নজর রাখার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা।