ডাউন সিনড্রোম বা অটিজম থাকলে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য 'ডিএমটি' করান
ডান্স এন্ড মুভমেন্ট থেরাপি করানোর জন্য প্রশিক্ষককে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়
- Total Shares
২০০৩ সালে ডাক্তারি পড়ার সঙ্গে যখন পেশাদার ভাবে ওড়িশি নাচ করছি তখনই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সমন্ধে অল্পবিস্তর পড়াশোনা শুরু করি। এ ব্যাপারে অনুপ্রেরণা ছিলেন আমার এক অধ্যাপক, যাঁর সন্তানের অটিজম ছিল। ধীরে ধীরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সম্পর্কে আমার কৌতূহল বাড়তে থাকল। তার জেরই এমন একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হই যাদের আমি নাচের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের দিতে থাকি। তবে সেটা ডিএমটি ছিল না।
সংস্থাটির সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমি অনুভব করি যে, যে সব শিশুর অটিজম রয়েছে তাদের চাহিদাগুলো আর পাঁচটা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের মতো নয়, তাই আমি অটিস্টিক বাচ্চাদের নিয়ে আরও পড়াশোনা করতে থাকি।
এরপর বিবাহ সূত্রে আমি আমেরিকা চলে যাই। তখন আমি শিশু রোগের চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি এবং সেই সংস্থাতেই আমি ডিএমটি সম্বন্ধে জানতে পারি। এই সময় ওই দেশের এমন একটি সংস্থার সঙ্গেও কাজ শুরু করি যারা এই ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করে। এখানেই আমি প্রথম 'ডান্স অ্যান্ড মুভমেন্ট থেরাপি' (ডিএমটি) সম্বন্ধে জানতে পারি। এর আগে ডিএমটি সম্বন্ধে আমার তেমন একটা জ্ঞান ছিল না।
তারপর আমার একটি ছেলে হয় এবং ঘটনাচক্রে তার মধ্যেও অটিজমের বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনার তাগিদটা আরও বেড়ে যায়। বিদেশে থাকাকালীন ডিএমটি নিয়ে আমি কয়েকটি প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা করি।
দেশে ফিরে আমি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য 'সাম্য ফাউন্ডেশন' নামে একটি সংস্থা তৈরি করি। এখানে বিশেষচাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সঙ্গে ডিএমটির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি। এবং ডাক্তারির সঙ্গে এটাও চলতে থাকে।
এবার আসি এই থেরাপিটি ঠিক কী সে বিষয়ে। আমাদের দেশে এই থেরাপিটি এখনও খুব একটা জনপ্রিয়তা না পেলেও বিদেশে এই থেরাপিটি অনেকদিন ধরেই ব্যবহার করা হয়। এটি একটি সাইকোথেরাপিউটিক পদ্ধতি, অর্থাৎ যখন বিশেষ ধরণের নাচ কিংবা গানের সাহায্যে একজনের গতিবিধি, হাঁটাচলা, বুদ্ধির বিকাশ, নিজের আবেগগুলোকে বুঝতে সাহায্য করা হয়। আরও সহজে বলতে হলে বলা যেতে পারে ডিএমটির সাহায্যে একজন ব্যক্তির চলাফেরা ও তার আবেগগুলোকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে এই দুটির মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করতে সহায়তা করে। এই পদ্ধতিতে একটি শিশুর যে মূল সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলিকে ঠিক করার চেষ্টা করা হয়।
ডিএমটির সাহায্যে ডাউন সিনড্রোম যুক্ত শিশুদের ভীষণ ভাবে সাহায্য হয়। নিয়মিত এই থেরাপিটি চালিয়ে গেলে তাদের মনোযোগ বাড়ে ও অন্যান্যদের দেখাদেখি বিভন্ন কাজ তারা অনেক সহজ ভাবে করতে পারে। যে সব শিশুর এপিলেপ্সি বা মৃগীরোগ আছে তাদেরও অনেকাংশে উপকার হয়। এই সব শিশুদের বিভিন্ন ওষুধ খেতে হয় বলে তারা অনেক সময় একটু ঝিমিয়ে থাকে কিংবা অনেকের বারংবার মৃগীরোগে আক্রান্ত হয় বলে তাদের চলাফেরা বা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সমস্যা দেখা দেয়। ডিএমটির মাধ্যমে এদের অনেকটাই মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তেমনভাবেই ডিএমটির সাহায্যে অটিস্টিক শিশুদের নিজেদের পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে আরো বেশি সচেতন করে তোলে এবং তাদের মনোযোগ বাড়াতেও সহায়তা করে। এই ভাবে তারা তাদের আশপাশের লোকজনের সঙ্গে বেশ দক্ষভাবে একটা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। যদিও আমি সেরিব্রাল পালসির বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দিই না, তবে দেখা গেছে ঠিক ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে এদেরও অনেকটা উপকার হয়। যাঁরা পার্কিনসনস রোগে ভুগছেন তাঁদের এই থেরাপিটি খুব কাজ দেয়।
এই ডিএমটি থেরাপি পাশাপাশি চালিয়ে গেলে একটি বাচ্চা অনেক তাড়াতাড়ি ও সক্ষমভাবে চিকিৎসায় সাড়া দেয়। তাই অন্যান্য থেরাপি ও চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো চালিয়ে যাওয়াটা একান্ত প্রয়োজনীয় সেগুলো বাদ দিলে চলবে না। ওষুধ ও থেরাপি সঙ্গে ডিএমটিও যদি চালিয়ে যাওয়া যায় তাহলে মস্তিস্ককে আরও বেশি সক্রিয় ও সজাগ করে তোলা সম্ভব।
তবে একটা খুব দরকারি কথা মাথায় রাখতে হবে সেটা হল এই থেরাপি মানে কিন্তু বাচ্চাকে গানের বা নাচের ক্লাসে ভর্তি করা নয়। এই চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য প্রশিক্ষককে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। অনেকেই এই থেরাপিকে মিউজিক থেরাপির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন।
তবে ক্রমশই মানুষ এই থেরাপিটির উপকারিতা সম্পর্কে লোকে সচেতন হচ্ছেন। শুধু তাই নয় নাচ ও গানের আমাদের মনের উপর একটা ভালো প্রভাব রয়েছে এবং ডিএমটি সাধারণ মানুষকেও সাহায্য করে তাই এখন বিভিন্ন স্কুল ও নানা সংস্থায় ডিএমটির কর্মশালা করানো হয়ে থাকে।