অসংখ্য রোগীর প্রাণ বাঁচাচ্ছেন যাঁরা তাঁদের প্রাণের দাম এত কম কেন?
আরজি কর হাসপাতালে রেডিয়েশন অঞ্চলটির দুরবস্থার জন্য নোটিশ জারি করা হয়
- Total Shares
যাঁরা প্রত্যেকদিন শয়ে শয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সহায়ক হন সেই সব মানুষের জীবন ঠিক কতটা নিরাপদ? বুঝলেন না? আমি বলছি আমাদের মতো ল্যাব টেকনিশিয়ানদের কথা। যে সব স্বাস্থ্যকর্মী ক্যাথ ল্যাব, সিটিস্ক্যান, এক্স-রে, লিনিয়ার অ্যাকসিলারেট যন্ত্রের সামনে কাজ করেন এই কারণে তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ এই সব যন্ত্র থেকে ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয় ক্ষতিকর সব রশ্মি যা বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কোনও উপায় নেই তাই বাধ্য হয়েই চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানদের এই রকম বিপদের মধ্যে কাজ করে চলতে হচ্ছে।
ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগের কারণ এই শক্তিশালী রশ্মি। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আছে এবং অস্থি দুর্বল হয়ে পড়ে।
আচমকাই আবিষ্কার হয় এক্সরে
বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ এবং প্রাইভেট হাসপাতালগুলিতে রয়েছে এক্স-রে, রেডিওথেরাপি ও ক্যাথ ল্যাবের মতো সুব্যবস্থা। এমনকি এ যুগে শহরের অলিতে গলিতে রয়েছে ডায়াগন্যাস্টিক সেন্টার যেখানে এই ধরণের যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে। রোগনির্ণয় এবং রোগ নির্মূল করার জন্য এই পরীক্ষাগুলি অপরিহার্য।
আজ বিভিন্ন খবরের ও স্বাস্থা সম্পর্কিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা সবাই জানি যে এই ধরণের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মানব দেহের ঠিক কতটা ক্ষতি সাধন করে এবং এর কুপ্রভাবে কী ধরণের মারাত্মক অসুখও হতে পারে।
যেসব স্বাস্থ্য কর্মীরা সারাক্ষণ এই ল্যাবে একের পর এক এক্স-রে বা সিটিস্ক্যান কিংবা এইধরণের কাজ করছেন তাঁদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি আরও অনেক গুণ বেড়ে যায়।
কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ঠিক কতটা সুরক্ষিত পরিবেশে ওখানকার চিকিৎসক, ল্যাব টেকনিসিয়ান এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করতে পারেন?
তাই যেমন অনেকেকেই সতর্কতা অবলম্বন করেন তেমনই আবার অনেকেই এই বিষয় অবগত থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা গ্রহণ করতে পারেন না কারণ এমন বহু স্বাস্থ্য কেন্দ্র এমনকি বহু বড় হাসপাতাল আছে যেখানে যথেষ্ট মাত্রায় সেসব বিশেষ ধরণের জামা বা পদ্ধতি নেই যেগুলো ব্যবহার করলে এই সব ল্যাব টেকনিশিয়ান ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকি অনেকটা কমতে পারে।
এই ধরণের তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে গেলে প্রয়োজন বিশেষ কয়েকটি জিনিসপত্রের যেমন লেড শিল্ড বা থাইরয়েড কলার কিংবা আন্ডার প্রটেক্টর, টিএলডি (thermoluminescent dosimeter) কার্ড, লেড অ্যাপ্রন, বিশেষ ধরণের চশমা ও টিএলডি ব্যাজ সহ বিভিন্ন জিনিস।
আরজিকর হাসপাতালে রেডিয়েশন অঞ্চলটির দুরবস্থার জন্য নোটিস জারি করাও হয়
ল্যাব টেকনিশিয়ানরা প্রক্রিয়াটি করার সময় নিজেদেরকে মারাত্মক রশ্মির কবল থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালেই সেই পরিকাঠামো থাকে না। শুধু তাই নয়, সঠিক নিয়ম যদি মানা হয় তাহলে হয়তো দেখা যাবে যে যেসব ঘরে এক্সরে কিংবা সিটিস্ক্যান হয় তার বেশিরভাগ ঘর এই পদ্ধতির জন্য উপযুক্তই নয়। কারণ যেই ঘরে এই প্রক্রিয়া হবে সেই ঘরের দুটো স্তরে দেওয়াল গাঁথতে হয় প্রথমটি ৩৫ সিমি মোটা ইট ও পরেরটি ২৩ সিমি মোটা ইট ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি নিয়ম মেনে এই ঘরগুলি বানাতে হয় যাতে রশ্মি কোনও ভাবেই ঘর থেকে বেরোতে না পারে। এর থেকে খুব পরিষ্কার যে এই রশ্মিগুলো এতটাই শক্তিশালী যে যথাযত ভাবে ঘরগুলো তৈরি না করলে আশপাশে থাকা মানুষজনের ও যথেষ্ট ক্ষতি হতে পারে। শিক্ষানবিশ বা ট্রেনিদের ক্ষেত্রে এক বছরে কোনও ভাবেই ছয়ে এমএসভি (মিলিশিয়ভার্ট)-এর বেশ রশ্মিতে থাকা অনুচিৎ। কিন্তু এখানকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে তেমনটা হয় না কারণ এখানে এই সব ট্রেনিদেরও প্রচুর কাজের চাপ থাকে। যে সব স্বাস্থ্যকর্মীরা এই ধরণের ক্ষতিকর রেডিয়েশনের মধ্যে কাজ করেন তাঁকে কোনও মতেই ছ'ঘন্টার বেশি সেই জায়গায় কাজ করা উচিৎ নয়।
এসএসকেএম হাসপাতাল যেখানে প্রত্যেকদিন হাজার হাজার রোগী আসেন সেখানে রেডিয়েশন কর্মীদের কোনও রকম নিরাপত্তা ছাড়াই দিনরাত কাজ করে যেতে হয় ওই ঘরে। অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড সমস্ত হাসপাতালের রেডিয়েশন অঞ্চলের নিয়মিত পরিদর্শন করেন কোনও রকম ত্রুটি আছে কী না দেখা জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শুধু এসএসকেএমই নয় বহু সরকারি হাসপাতালে এই পরিদর্শনের কোনও বালাই নেই বললেই চলে। মজার ব্যাপার হলো এসএসকেএম-এ একজন আধিকারিকও নিযুক্ত আছেন যিনি রেডিয়েশন থেকে যাতে সেখানকার ল্যাব কর্মী কিংবা মানুষজন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেই দিকের দিকে নজর রাখেন। যদিও আজ প্রায় ১৫ বছর হল এখানকার রেডিয়েশন ল্যাবে টিএলডি যন্ত্রপাতি নেই এবং যেগুলো রয়েছে সেগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের ও বেশ পুরোনো।
লেড এপ্রোন পড়লে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমে যায়
সম্প্রতি আরজিকর হাসপাতালে রেডিয়েশন অঞ্চলটি পরিদর্শন করতে এসে ওখানকার অবস্থা দেখে হাসপাতালকে একটি নোটিশ জারি করাও হয়।
তবে যেসব মানুষ নিজেদের অজান্তেই এই সব ক্ষতিকর রশ্মির কবলে পড়ছে তাঁদেও এবার সচেতন হতে হবে। এ ছাড়াও যাঁরা এই সব স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকেন তাঁদের ও নানা রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাহলে কী বাড়ি বিক্রি করে অনত্র গিয়ে বাস করবেন? না একদমই নয়। প্রয়োজন একটু সচেতনতার এবং আরও দায়িত্বশীল হতে হবে আমাদের সবাইকে। যেখানে এই যন্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয় সেই ঘরের নির্মাণের নিয়ম মেনে ঘর বানাতে হবে পাশাপাশি টেকনিশিয়ানদের সুরক্ষার কথা মাথায় রাখতে হবে।