অতিরিক্ত কার্টুন দেখলে শিশুদের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, বাড়ে মানসিক চাঞ্চল্যও
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ইঁদুর দৌড়ে তাদের ছোটবেলা থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়
- Total Shares
ছোট হোক বা বড়, সবারই বিনোদনের প্রয়োজন আছে। এই প্রতিযোগিতার যুগে একটি শিশুকে ইঁদুর দৌড়ে টিকে থাকার লড়াইতে ছোটবেলা থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শিশুরা একটা গতে বাঁধা জীবনের মধ্যে বাস করে সব সময়। ঘুম থেকে উঠে পড়াশোনা তারপর স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা তারপর আবার বাড়ি ফিরে কোচিং ক্লাসে যাওয়া। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তারা মানসিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। খেলাধুলোর পর্ব এখন প্রায় চুকে গেছে বললেই চলে। অনেক সময় আমরা বড়রা ভাবিই না যে ছোটদেরও মানসিক ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও এখন অনেক কমে গেছে।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বাড়িতে দাদু-ঠাকুমার কাছে বিভিন্ন গল্প শুনতাম, মাঠে গিয়ে খেলাধুলো করতাম কিন্তু এখন আর সে অবকাশ নেই। পরিবারগুলোয় সদস্যসংখ্যা যেমন কমে গেছে ঠিক তেমন ভাবেই খেলার মাঠগুলো ছোট হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই আগে যেমন জীবনের আদর্শ হিসেবে আমরা আমাদের বাবা-মা কিংবা দাদু-দিদিমাকে চিন্তা করতাম সেই জায়গাটা এখন নিয়েছে সিনেমার বা কার্টুনের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও ভিলেনরা।
বর্তমান যুগে একটি শিশুর পরমবন্ধু হয়ে ওঠে কার্টুনের চরিত্রগুলো। অনেক শিশুর মধ্যে আবার অসম্ভব সিনেমা দেখার নেশা দেখা যাচ্ছে। তাই আমি বলব অন্য কোনও অকাজের কিছু দেখার চেয়ে ঢের ভালো এই সব কার্টুন দেখা।
তবে প্রদীপের নীচেই যেমন রয়েছে অন্ধকার তেমনই অতিরিক্ত মাত্রায় কিছু করলে তারও একটা অপকারিতা থাকবেই। তাই শিশুদের কার্টুন দেখার ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।
মনে রাখতে হবে কোনও কিছুর প্রতি নির্ভরশীলতা কোনও কাজের কথা নয়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে কিংবা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময়টাই যদি একটি শিশু কার্টুন দেখে তাহলে অবশই চিন্তার বিষয় আছে। এর ফলে শিশুটি সারাদিনই একটা ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে বিচরণ করছে এবং তার বাস্তবের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ থাকে না বললেই চলে এমনকী সে বাড়ির পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলাই প্রায় বন্ধ করে দেয়।
গোড়ার দিকে অভিভাবকরা তেমন একটা মাথা ঘামান না বরং নিজেদের কাজগুলো শেষ করতে পারবেন ভেবে সন্তানকে টিভিতে কার্টুন দেখতে বসিয়ে দেন। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহারের থেকে অপব্যবহারটাই বেশি হয়।
বেশ কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কার্টুনগুলো এতটা মারমুখী গোছের ছিল না। এখন কার্টুনে বিভিন্ন রকম অস্ত্র ব্যবহার করা দেখানো হয় তাছাড়া কার্টুনগুলোতে এমন সব কার্যকলাপ দেখানো হয় যেগুলো দেখে শিশুরা প্রভাবিত হয় ও বাস্তবে ঠিক তেমনটাই করতে চেষ্টা করে যার ফলে মারাত্মক সব দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এখানে শুধু কার্টুনের কথা বললেই হবে না কারণ বহু বাচ্চা মারামারি বা রেসলিং কিংবা কিকবক্সিং দেখতে খুব ভালোবাসে। অনেক সময় তারা এমন সিনেমাও দেখে দেখে যেখানে অপরাধের দৃশ্য রয়েছে। শিশুমনে এসব খুব সহজেই দাগ কাটে এবং তারা মনে করে তারাও যদি এমন কিছু আচরণ করে তাহলে সেটা খুব একটা দোষের হবে না।
এখন ভিডিও গেমগুলোতে সিমুলেটরের মাধ্যমে বোমা ফেলা দেখানো হচ্ছে বা বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে, এইরকম নানা কিছু দেখানো হচ্ছে। এই সব দেখতে দেখতে ক্রমশই শিশুদের মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ জন্ম নিচ্ছে।
অতিরিক্ত কার্টুন দেখার অপকারিতা:
১. বাচ্চারা কার্টুনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ে।
২. কার্টুন দেখতে দেখতে তারা এই ভার্চুয়াল জগৎকেই আসল বলে মনে করে এবং বাস্তবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।
৩. আসল জীবনে সম্পর্কের জায়গাগুলো খুব গোলমেলে হয়ে পড়ে।
৪. তারা খুব মারমুখী হয়ে পড়ে।
৫. অতিরিক্ত কার্টুন দেখার ফলে শরীরের উপর তার প্রভাব পরে। কারণ অনেক সময় বাচ্চারা দীর্ঘক্ষণ টিভি দেখতে দেখতে সারাক্ষণ কিছু না কিছু খেতে থাকে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাদের শরীর খারাপ হয়।
৬. দীর্ঘক্ষণ টিভি বা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের উপরে চাপ পরে ও চোখ খারাপ হয়ে যেতে পারে।
কী ভাবে শিশুকে কার্টুনের আসক্তি থেকে দূরে রাখবেন:
১. এখন এমন অনেক চ্যানেল হয়েছে যেখানে সারাদিনই প্রায় কার্টুন দেখানো হয়। তাই কার্টুন দেখার একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে হবে। ধরুন সারাদিনে পড়াশোনা শেষ হলে ৩০ মিনিট কার্টুন দেখার জন্য বরাদ্দ থাকবে তাদের। এভাবে সে সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির পর কিছুটা সময় নিজের জন্য নিজের মতো করে কাটাতে পারে।
২. অভিভাবকদের উদ্দেশে বলব, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান। সন্তানকে খেলার মাঠে নিয়ে যান কিংবা তার সঙ্গে বসে ভালো ভালো বই পড়ুন এর ফলে তার মন শুধুমাত্র কার্টুনের দিকেই পড়ে থাকবে না।
৩.পরিবারের সকলের সঙ্গে বাচ্চাদের সম্পর্কের সমীকরণটা তাদের বোঝাতে হবে। পাশাপাশি তাদের কোনটা ভুল বা কোনটা ঠিক সেটাও বোঝাতে হবে।
৪. শিশু কোনও ভালো কিছু করলে বা একদিন কম কার্টুন দেখলে ওকে প্রশংসা করুন। আপনার প্রশংসা ওকে উৎসাহিত করবে।
৫. ও যে কাজটা করতে ভালোবাসে যেমন কেউ আঁকতে ভালোবাসে আবার কেউ হাতের কাজ করতে ভালোবাসে, তাদের সেই কাজগুলো করতে আরও উৎসাহিত করুন।
কার্টুন জগৎ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করার কথা বলছি না, তবে তারা যাতে সৃজনশীল কিছু করে সে দিকেও নজর দেওয়া উচিৎ মা-বাবার।