কংগ্রেসের ১৩৪ বছরের ইতিহাসে অপ্সরা রেড্ডিই প্রথম যিনি রূপান্তরকামী হিসাবে ভোটে লড়ছেন

প্রান্তিকদের কি তিনি মূল ধারায় ফেরাতে পারবেন? তিনি কি নজির গড়তে পারবেন?

 |  5-minute read |   24-03-2019
  • Total Shares

এক সময়ের সাংবাদিক ও তামিলনাড়ুর সমাজকর্মী রূপান্তরকামী অপ্সরা রেড্ডিকে ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি মহিলা কংগ্রেসের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ করে কংগ্রেস – ১৩৪ বছরের জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে অপ্সরা রেড্ডিই হলেন প্রথম রূপান্তরকামী ব্যক্তি যিনি কোনও উচ্চপদে আসীন হলেন।

জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও ঘোষণার সেই মূহূর্তটাকে নতুন যুগের সূচনা বলে ঘোষণা করেছিল এবং একে প্রগতিশীল এবং ভারতীয় রাজনীতিতে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিত্বের নিরিখে উপযুক্ত ভাবে সামনের দিকে চলার পদক্ষেপ বলে মনে করেছিল। নির্বাচনী ক্ষেত্রে তখন প্রায় অন্ধকারে থাকে আপাত নিরীহ ‘অন্যান্য’ শ্রেণীভুক্তরা আশ্রয় পাওয়ার মতো একটা মুখ খুঁজছিলেন। এর চেয়েও বড় কথা হল, তাঁদের কথা বলার মতো একজন নেতৃত্বস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে খুঁজছিলেন।

সম্প্রতি আমি অপ্সরা রেড্ডির সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তিনি যেদিন কারুর অথবা অর্নি লোকসভা আসন দু’টির মধ্যে কোনও একটি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়ে আবেদন করেন ঠিক তার এক দিন পরে – তখন তাঁর মেজাজ বেশ তুঙ্গে ছিল।

তিনি বলেন, “আমাকে সাধারণ সম্পাদক পদে যে রাহুল গান্ধীজি নিয়োগ করেছিলেন তা রূপান্তরকামীদের মূলস্রোতে ফেরানোর ব্যাপারে একটা বড় পদক্ষেপ ছিল কারণ লিঙ্গের বিচারে রূপান্তরকামীদের সংখ্যালঘু হিসাবেই দেখা হয় এবং প্রায় কোথাও তাঁদের কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। সংসদে যদি রূপান্তরকামীদের কণ্ঠও শোনা যায় তা হলে তা হবে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তি এবং সাম্যের পথে চলার ক্ষেত্রে তা দিশা দেখাবে। প্রায়শই একটা ব্যাপার দেখা যায়, আমাদের চিন্তাভাবনা এমন একটি পর্যায়ে রয়ে গেছে যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিল যখন তৈরি প্রস্তুত হয় তখন হয় আমাদের কথা সেখানে বিবেচনা করা হয় না নতুবা নামমাত্র বিবেচনা করা হয় এবং তার জেরে বাস্তবে আমরা নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হই। সংসদে যখন প্রতিটি সংখ্যালঘু শ্রেণী থেকে সদস্য রয়েছেন এবং তাঁরা তাঁদের অধিকারের কথা বলতে পারেন তখন আমরাও আমাদের কথা এবং আমাদের সত্যিকারের ক্ষমতায়নের ব্যাপারে সেখানে বলতে পারি। রূপান্তরকামী মহিলারা (Transwomen) চিরকালই ব্রাত্য, তাঁদের দেখে লোকে হাসাহাসি করেন, তাঁদের নামে যা-তা বলেন, হেয় ও অপদস্থ করেন এবং শিল্পসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাঁদের সেই একই অবস্থা – মনে করা হয় যে আমরা যেন অন্য কোনও গ্রহের প্রাণী – এবং যখন কোনও রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো সমানাধিকারের সুযোগ আমাদের দেয় এবং আমরা নিদের নির্বাচনী কেন্দ্রের জন্য প্রচার করতে পারি একমাত্র তখনই আমরা আমাদের বেড়ি ছিন্ন করতে সক্ষম হতে পারি।”

1apsara-reddy-inside_032419074050.jpgকংগ্রেসের ইতিহাসে অপ্সরা রেড্ডিই প্রথম রূপান্তরকামী যিনি কোনও উচ্চপদে আসীন হলেন। (উৎস: টুইটার/কংগ্রেস)

রূপান্তরকামী ও নপুংসকদের জন্য ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় যখন নির্বাচন কমিশন ‘অন্যান্য’ বলে একটি বিভাগ চালু করে তখন ‘অন্যান্য’ বিভাগে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করিয়েছিলেন ২৫,৫২৭ জন এবং ২০১৯ সালে তা মোটামুটি ভাবে ৪৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছ ৪১,২৯২-এ। ২০১৪ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে কেরল, মণিপুর, মিজোরাম, সিকিম, ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, চণ্ডীগড় এবং দমন ও দিউতে ‘অন্যান্য’ বিভাগে নাম নথিভুক্ত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছর লোকসভা ভোটের সময় এই সব রাজ্যগুলির ভোটার তালিকায় ‘অন্যান্য’ বিভাগে ভোটাদাতার সংখ্যা ছিল শূন্য।

সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভোটার তালিকায় ‘অন্যান্য’ বিভাগে নাম নথিভুক্তির ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (৮৪২৬), তার পরে রয়েছে কর্নাটক (৬১৩২), তামিলনাড়ু (৫৪৭২) ও অন্ধ্রপ্রদেশ (৩৭৬১)।

‘অন্যান্য’ বিভাগে একজনও ভোটার নেই এমন রাজ্য বাদ দিলে এই বিভাগে সবচেয়ে কম ভোটার রয়েছেন দমন ও দিউ (১), সিকিম (২) এবং মিজোরামে (৬)।

যে দেশে এখনও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রযেছে – ক্ষমতা যেখানে বংশ বা গোষ্ঠী যেমন ছেলে, ভাই বা ভাইপোর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং যেখানে আর কেউ নেই সেখানে জামাইয়ের হাতে সেই ক্ষমতার ব্যাটন যায় – সেই দেশের কাছে তাঁর প্রত্যাশা কী, সে কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম অপ্সরা রেড্ডিকে। দল তাঁকে যে বিপুল ভাবে স্বাগত জানিয়েছে তার বাইরে গিয়ে তিনি কি পারবেন উত্তরাধিকারের যে রাজনৈতিক রং পেশীশক্তি রয়েছে তা দেখে চোখ বন্ধ করে রাখতে?

2download_032419074125.jpgসংসদে যদি রূপান্তরকামীদের কণ্ঠও শোনা যায় তা হলে তা হবে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তি এবং সাম্যের পথে চলার ক্ষেত্রে তা দিশা দেখাবে। (ছবি: রয়টার্স)

মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে তিনি একে বিপক্ষ দল বিদেপির ‘টোকেন স্লোগান’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “সমাজব্যবস্থা মূলত পুরুষশাসিত হওয়ায় ভারতে এখনও মহিলারা প্রধাণত পুরুষদের উপরেই নির্ভরশীল। তবে এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে – নতুন ভোটদাতারা চান নতুন যুগের, প্রগতিশীল, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা যিনি দুর্নীতি থেকে মুক্ত। গণতন্ত্র হল এমন জায়গা যেখানে সকলে সমান এবং রূপান্তরকামীরাও সমান ভাবে অংশগ্রহণের অধিকারী। তা সে যে দলই হোক না কেন, তামিলনাড়ুতে পুরুষ প্রার্থীর তুলনায় মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা অনেক কম – আশা করি এই পরিস্থিতিরও বদল হবে। জাতীয় স্তরে হোক বা জেলা থেকে ব্লক স্তরে হোক, আমাদের নেত্রী দরকার।”

১৯৬২ সাল থেকে লোকসভায় মহিলারা ছিলেন – কিন্তু শতাংশের বিচারে লোকসভায় তাঁদের প্রতিনিধিত্ব ছিল খুবই কম এবং ২০০৯ সালে প্রথম বারের জন্য তা ১০ শতাংশের বেশি হয়। ২০১৪ সালে লোকসভার জন্য মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৮.১ শতাংশ। খুব কম হলেও সর্বকালীন বিচারে এটাই ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সংসদে প্রত্যক্ষ ভাবে নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন মাত্র ১১.৬ শতাংশ।

সংসদে ২০১৭-১৮ সালের যে অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে তাতে সক্রিয় রাজনীতিতে মহিলাদের যোগদান সে ভাবে না থাকার কারণ হিসাবে সাংসারিক দায়দায়িত্ব, সমাজে মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে মানসিক অবস্থান এবং পারিবারিক সহায়তা না পাওয়াকে প্রাথমিক কারণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।

ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) এবং ইউএন উওম্যান রিপোর্ট – উইমেন ইন পলিটিক্স – উদ্ধৃত করে সমীক্ষায় জানানো হয়েছে লোকসভায় ৬৪ জন (৫৪২ জন সাংসদের মধ্যে ১১.৮ শতাংশ) এবং রাজ্যসভায় ২৭ জন (২৪৫ জন সাংসদের মধ্যে ১১ শতাংশ) মহিলা সাংসদ আছেন।

একজন মহিলার ক্ষেত্রে পেশা হিসাবে রাজনীতিকে বেছে নেওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাব ও আর্থিক সমস্যাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

3apsara-reddy-campai_032419074150.jpgঅপ্সরা রেড্ডি কি লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে পারবেন? তিনি কি সত্যিকারের নেত্রী হয়ে উঠতে পারবেন? (উৎস: অপ্সরা রেড্ডি/টুইটার)

২০১৮ সালের ইন্ডিয়াস্পেন্ড রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে যেখানে মহিলা ভোটদাতাদের ভোটদানের হার দেশজুড়ে বাড়ছে, ১৯৮০ সালে ৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৬৬ শতাংশ হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন রাজ্যে জনসংখ্যার নিরিখে প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের অনুপাত (অ্যাডাল্ট পপুলেশন সেক্স রেশিও) বিচার করা হয় তবে দেখা যাবে তা একেবারেই লজ্জাজনক। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেখা গিয়েছিল যে রাজ্যের নারী-পুরুষের সংখ্যার আনুপাতিক হিসাবে মধ্যপ্রদেশে মহিলাদের প্রদত্ত ভোটের হার সবচেয়ে কম ছিল, যেখানে অরুণাচলপ্রদেশে (জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের আনুপাতিক হিসাব ধরে) মহিলাদের প্রদত্ত ভোটের হার ছিল সবচেয়ে বেশি।

নির্বাচন কমিশনের এসভিইইপি প্রকল্পের বদান্যতায় ও তাদের অবিশ্বাস্য চেষ্টার ফলে রাজনীতিতে মহিলাদের যোগদান বেড়েছে – নির্বাচক তালিকায় আরও বেশি করে নাম নথিভুক্ত হচ্ছে এবং বিপুল সংখ্যক নির্বাচনকে নাম পঞ্জীকৃত হচ্ছে এসভিইইপি প্রকল্পের অধীনে। আসন্ন নির্বাচনের পরে এই বিষয়টি সেক্স কম্পোজিশনটি আরও ভালো ভাবে বিচার-বিবেচনা করা যাবে।

সে যাই হোক, অপ্সরা রেড্ডি কি তাঁর দলের হয়ে নজির সৃষ্টি করবেন? অন্তত এখনকার মতো? নাকি তিনিই আমাদের দেশের নারীদের কণ্ঠ হয়ে উঠবেন? – প্রান্তিকদের তিনি মূল ধারায় নিয়ে আসবেন ও লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে বড় ভূমিকা নেবেন – হয়তো এটা খুব বড় প্রশ্ন এবং বিতর্কের বিষয়ও বটে, শুধু রাহুল গান্ধী বা তাঁর দল কংগ্রেসের জন্য নয়, এটা জেন্ডার বায়োমেট্রিক্স ও এই ধরনের সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছেও বড় একটা চ্যালেঞ্জ।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SREEMOYEE PIU KUNDU SREEMOYEE PIU KUNDU @sreemoyeekundu

The writer is an ex lifestyle editor and PR vice president, and now a full-time novelist based in Delhi. She's the author of Faraway Music, Sita's Curse and You've Got The Wrong Girl! Also, a columnist on sexuality and gender and the recipient of NDTV L'oreal Women of Worth Award in the 'Literature' category.

Comment