কৃত্রিম গর্ভের আবিষ্কার নিঃসন্তান দম্পতির জন্য এনে দেবে আশার আলো
ভারতে প্রত্যেক বছর প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি শিশুর মাতৃকালীন জটিলতায় মৃত্যু হয়
- Total Shares
১৯৯৬ সালে ডলি নামে একটি ভেড়া স্তনপায়ী প্রাণীদের মধ্যে প্রথম ক্লোন করে জন্মে ছিল বলে খবরের শিরো নামে আসে। আরও স্তনপায়ী প্রাণীদের ক্লোন করার পথ ডলিই তৈরি করে দেয়। যদিও স্কটল্যান্ডের গবেষকদের ক্লোন করে তৈরি এই ভেড়াটি বেশি দিন বাঁচেনি কিন্তু ডলি ছ'টি শাবকের জন্ম দিয়েছিল।
নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় এটা ছিল একটা যুগান্তকারি এবং একই সঙ্গে বিস্ময়কর সৃষ্টি। যদিও ওই সময় এই সৃষ্ঠিতিকে ঘিরে নানা কথা ওঠে ও উন্মাদনা তৈরি হয়, কারণ তখন মনে করা হয়েছিল যে এই প্রযুক্তিটি "ডিজাইনার বেবিস" তৈরি করার জন্য এই প্রযুক্তিটির অপব্যবহার হতে পারে।
এর প্রায় কুড়িবছর পর একদিন আমি যখন আমার অফিসে বসেছিলাম তখন 'নেচার' বইটিতে একটি লেখা দেখে আমার কিছু পুরোনো কথা মনে পরে গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার কয়েকজন গবেষক একটি বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটিয়েছেন। ওখানকার চিলড্রেন হস্পিটাল নামক বাচাদের একটি হাসপাতালের কয়েকজন গবেষক মিলে একটি কৃত্রিম গর্ভের সৃষ্টি করেছেন।
এখনও পর্যন্ত প্ৰিমেচিযর শিশু জন্মালে তাদের ইনকিউবেটরের মধ্যে ভেন্টিলেটরে রাখা হত। কিন্তু গবেষকরা এখন একটা বিকল্প উপায় বের করেছেন। তাঁরা যে কৃত্রিম গর্ভের সৃষ্টি করেছেন সেটা তরল পদার্থে পূর্ণ একটা স্বচ্ছ আধার যার মধ্যে ভ্রুণকে স্থাপন করা হবে এবং তা বেড়ে উঠবে সেখানেই।
এহেন কৃত্রিম গর্ভটিতে একটি ভেড়া ভ্রুণকে পরীক্ষামূলক ভাবে রাখা হয়।
গবেষকদের ওই দলটি ঠিক কী ভাবে এই সৃষ্ঠিটা সম্ভব করেছিল সেটা ওই দলেরই অন্যতম গবেষক ড. এমিলী পার্ট্রিজ বিশ্লেষণ করলেন। তাঁরা ওই আধারটির মধ্যে অতন্ত্য ছোট একটা ভেড়া শাবকের ভ্রুণ পরীক্ষামূলক ভাবে ওই কৃত্রিম গর্ভে স্থাপন করা হয়। এর ঠিক চার সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় যে ছোট্ট শাবকটির গায় উল গজিয়েছে, সে নিশ্বাস নিচ্ছে ও আঁধারের তরল পদার্থটির মধ্যে চোখ খুলে সাঁতার কাটছে।
মায়ের গর্ভে ঠিক যে ভাবে ভ্রুণ থাকে ঠিক একই রকম ভাবে গবেষকরা একটি কৃত্রিম গর্ভ তৈরি করে। একজন মহিলার জরায়ুতে একটা তরল পদার্থ থাকে যাকে এমন ধরণের ফ্লুইড থাকে এই কৃত্রিম গর্ভ বিশেষ একটি তরল পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। এবং এর সঙ্গে যোগ করা হয় যন্ত্রচালিত একটি প্লাসেন্টাও যার মাধ্যমে শাবকের দেহে অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে।
এই দলের প্রধান গবেষক, ড. এলেন ডাবলু ফ্ল্যক বলেন যে, "পৃমেচিওর বাচাদের মৃত্যুর হারকে অনেক কম করার জন্য এই পদ্ধতিটি এখনও অন্য কোথাও কেউ করেননি"। ফ্ল্যক একজন ভ্রুণ সার্জন ও ফিলাডেলফিয়ার চিলড্রেন'স হসপিটালে সেন্টার ফর ফিটাল রিসার্চ-এর পরিচালক।
যদিও গবেষকের দল তাঁদের সৃষ্টিতে বেশ সন্তুষ্ট হলেও মানুষের ক্ষেত্রে এই গবেষণাকে কাজে লাগাবেন আরও বেশ কিছু বছর পর। শিশু মৃত্যুর একটা বড় কারণ হল নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই তাদের জন্ম হয়ে যাওয়া। যেই সব শিশুরা ২৬ সপ্তাহের আগেই জন্মায় তাদের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ থাকে ও অনেক সময় তারা নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়েও জন্মায়।
ডলি প্রথম স্তনপায়ী প্রাণী যার ক্লোনিং করা হয়েছিল
এই সব শিশুদের ফুসফুসটা সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। কারণ একটা ভুল যখন গর্ভে তিলে তিলে তৈরি হয় তখন তার শরীরে একদম শেষ ফুসফুস তৈরি হয় তাই এই শিশুদের যাদের আবার ইংরেজিতে পৃমিসও বলা হয় জন্মানোর পরে তাদের ফুসফুস যাতে ভালো ভাবে তৈরি হতে পারে তাদের ভেন্টিলেটরে রাখা হয়।
সাম্প্রতিক এই গবেষণাটি ডাক্তারদের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে।
ওই দলটির মতে এই কৃত্রিক গর্ভটি মায়ের গর্ভ ও বাইরের জগতের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন করবে। এছাড়াও তাঁরা পরীক্ষামূলক ভাবে ভেড়ার থেকে নানা বয়সের বহু ভ্রূণ ওই কৃত্রিম গর্ভের মধ্যে স্থাপন করেন এবং দেখা যায় যে সেই ভ্রূণগুলো বেশ ভালো স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে উঠছে।
যদিও এই গবেষণাটি নানা বিতর্ক তৈরি করেছে।
আগে বিতর্কের ভালো কথাগুলো বলি:
এর ফলে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কম হবে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেসান জানাচ্ছে যে মতে বিশ্বের নানা জায়গায় প্রত্যেক বছর প্রায় ১৫ মিলিয়ন পৃমেচিওর শিশুদের মৃত্যু হয়। আর ভারতে এই সংখ্যাটা প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি পৌঁছে গেছে।
যদিও এই সব শিশুদের মৃত্যুর সঠিক সংখ্যাটা বলা সম্ভব নয় কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দরিদ্র লোকেদের মধ্যে ও উন্নত দেশের উচ্চ বৃত্তদের সঙ্গে কোনও তুলনামূলক সমীক্ষা এখনও পর্যন্ত্য করা হয়নি। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দরিদ্র লোকেদের মধ্যে এই শিশুদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সঠিক সংখ্যাটা হয়ত এখনকার সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।
তবে গর্ভকালীন জটিলতার সৃষ্টি হলে বিজ্ঞানের এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে মা ও সন্তান দুজনেই স্বস্তি পেতে পারে। মাতৃকালীন জটিলতায় একজন মা গর্ভাবস্থার পুরো সময়টা গর্ভে ভ্রুন ধারণ করে রাখতে অক্ষম হওয়ায় অনেক সময় গর্ভপাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়, সে ক্ষত্রে এই বায়ো-ব্যাগটির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এই আধারটিকে অনেক সময় বায়ো-ব্যাগও বলা হয়। ঠিক একইভাবে কোনও মায়ের যদি জীবনের আশঙ্কা জনক কোনও অসুখ থেকে থাকে যেমন উচ্চ রক্ত চাপ, ডিয়াবিটিস কিংবা পৃক্ল্যামপসিয়া তাহলে সেই শিশুটিকে ওই কৃত্রিম গর্ভে রাখা যায়।
মায়ের গর্ভে ঠিক যে ভাবে ভ্রুণ থাকে ঠিক একই রকম ভাবে গবেষকরা একটি কৃত্রিম গর্ভ তৈরি করে
মানব ভ্রুণ এই বায়ো-বাগে রাখা যাবে কিনা সেটা নিয়ে কয়েকটা নৈতিক প্রশ্ন উঠেছে। কথা উঠেছে যে মানব ভ্রূণ যদি এই ভাবে কৃত্রিম ভাবে বড় করা যেতে পারে তাহলে এই ভাবেই ভ্রুণ ব্যবহার করে অনেক শিশুর সৃষ্টি করা যেতে পারে। এখন স্বপ্নের মতো শোনালেও একশো বছরের মধ্যেই এই স্বপ্নটা বাস্তব রূপ নেবে।
এই মুহূর্তে গবেষণাটি শুরুর দিকে রয়েছে বলে মানব ভ্রুণ নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব নয়। আরও বেশ অনেকটা গবেষণা করে একটি সঠিক পরিমতিতে পৌঁছলেই মানব ভ্রূণের ক্ষেত্রে এই গবেষণাটি কাজে লাগানো যাবে।
গবেষণাটি নৈতিক ভাবে হলে ও এই বিষয়ে আরও একটু স্বচ্ছতা এলে বায়ো-ব্যাগ মানব সমাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। অনেক নিঃসন্তান দম্পতির জন্য ভবিষতে এটা একটা আশীর্বাদ হতে পারে।
এই লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন