কলকাতার শীতকাল অনন্য, বাঙালি মাত্রেই তাড়িয়ে উপভোগ করে
চিড়িয়াখানা থেকে পার্কস্ট্রীট আবার ইডেন গার্ডেন্স থেকে বাগানবাড়ীতে চড়ুইভাতি, যাকে বলে কমপ্লিট প্যাকেজ
- Total Shares
নয় নয় করে ৩২৮ বছর হতে চলল তিলোত্তমা কলকাতার। সেই কবে জোব চার্ণক এই শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তারপর বিভিন্ন জাতি ধর্মের লোকেরা এই শহরের বসবাস শুরু করে পাকাপাকিভাবে এই শহরেই রয়ে গিয়েছে। পাঞ্জাবি থেকে শুরু করে সিন্ধি, গুজরাটি মাড়োয়ারি এমনকি দক্ষিণ ভারতীয়রাও এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকেদের পাশাপাশি রয়েছে বিদেশ থেকে আগত পার্সি, আর্মেনিয়ান ও জুইশরাও। এছাড়া, 'ঘরের সন্তান' বাঙালিরা তো রয়েছেন। সব মিলিয়ে, কসমোপলিট্যান সংস্কৃতির এমন নিদর্শন মেলা ভার।
দেখতে দেখতে আবার শীতকাল ফিরে এল। আর, এই কসমোপলিট্যান সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ কলকাতার শীতকালটা কিন্তু বরাবরই অনন্য। বড়দিনের পার্কস্ট্রিট আবার নিউ ইয়ার ইভে কোনও নাইটক্লাবে রাতভর পার্টি - শহরবাসীরা যেন চেটেপুটে শীতকাল উপভোগ করেন। সাহেবিয়ানার পাশাপাশি রয়েছে বাঙালির নিজস্বতাও। শীতকালের পিঠেপুলি কিংবা নলেন গুড়ের সন্দেশ, শীতের ছুটিতে কচিকাঁচাদের চিড়িয়াখানা বা সার্কাস আর রবিবার বা অন্য কোনও দিন সকালের চড়ুইভাতি - সব মিলিয়ে বাঙালির যে পোয়া বারো।
বড়দিনের পার্কস্ট্রীট [ছবি: পিটিআই]
আসুন দেখে নেওয়া যাক কোন পাঁচটি কারণের জন্য বাঙালির শীতকাল সত্যি সত্যিই অনন্য।
১) পার্কস্ট্রিট: কলকাতার শীতকাল বলতে প্রথমেই হে রাস্তাটির কথা মনে পড়ে। বড়দিনের সন্ধ্যাবেলায় নিউমার্কেটের কেকের ঘ্রান নিতে নিতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ধরে সোজা পার্কস্ট্রিট। রাস্তার দু'ধারে দাঁড়ানো বৃটিশ আমলের (অধকাংশই) তৈরি একের পর এক বিলাহাবহুল রেস্তোরাঁ। চিনে খাবার থেকে বিফ স্টেক, চেলো কাবাব থেকে টেট্রাজিনি - বাঘের দুধটাই যা পয়সা দিলে মেলে না। পার্কস্ট্রীটের মজা নিতে আবার আপনাকে এই রাস্তায় ফিরতে হবে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনের ঠিক দিন ছ'য়েকের মধ্যে। ইংরেজি নববর্ষের আগের দিন রাতে। কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁয় ঢুকতে না পারলেও কুছ পরোয়া নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়েই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হয় হুল্লোড় করে বর্ষবরণ করে নিতে পারবেন।
২) চিড়িয়াখানা: অধুনা মহানগরীতে সাইন্স সিটি রয়েছে। কচিকাঁচাদের জন্য রয়েছে নিকো পার্ক বা অ্যাকুয়াটিকা। ইকো পার্ক তো শহরের নবতম সংযোজন। তাই বলে ১৮৭৬ সালে প্রতিতিষ্ঠ কলকাতা চিড়িয়াখানার জৌলুশ কিন্তু কোনও অংশে কম নয়। শীতের সকালে চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়ানো। দুপুরে ঘরের তৈরি খাবার খেয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া। সব মিলিয়ে কোথাও যেন একটা চড়ুইভাতির মেজাজ। এর সঙ্গে যদি একটি দাদুর লাল চুল, মানে ক্যান্ডি ফ্লস, পাওয়া যায় তাহলে তো আর কোনও কথাই নেই।
৩) ইডেনে টেস্ট: খোলা স্টেডিয়ামে বসে পশ্চিমের রোড পোয়ানো। সঙ্গে খোসা ছাড়িয়ে কমলা লেবু ভক্ষণ। খিদে পেলে টিফিন বাক্স খুলে বাড়ির তৈরি লুচি তরকারি বা ডিম পাউরুটি ভাজা, বাঙালি যাকে ফ্রেঞ্চ টোস্ট বলতে পছন্দ করে। ও, হ্যা, আসল উপলক্ষটাই বলা হল না। বিশ্বশ্রেষ্ট ক্রিকেটারদের মনোরম ব্যাটিং বা অনবদ্য বোলিং উপভোগ করা। শুনেছি একটা সময়ে মহিলা দর্শকরা নাকি ইডেনের গ্যালারিতে বসেও উল বুনতেন। কালের নিয়মে, নিরাপত্তাজনিত বাড়ির খাওয়া থেকে অনেক কিছুই বাদ পড়েছে। তাই বলে শীতের ইডেনে বসে টেস্ট ম্যাচ উপভোগ করার আকর্ষণে কিন্তু ঘাটতি পড়েনি।
শীতের ইডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখার মজাই আলাদা [ছবি: রয়টার্স]
৪) পিঠেপুলি/নলেন গুড়: খাদ্যরসিক বাঙালিদের শীতকালে নিজস্ব কিছু খাওয়ার থাকবে না তা আবার হয় নাকি। শীতকাল মানেই তো গুড় আর মোয়ার সময়ে। নলেন হোক বা পাটালি, পাটিসাপ্টা থেকে শুরু করে চালের পায়েস কিংবা জলভরা থেকে শুরু করে রসগোল্লা কয়ফোটা দিয়েই দেখুন না। বাঙালি চেটেপুটে খাবে। ঝোলাগুড় তো শুধু রুটি দিয়েই খাওয়া চলে। কী বললেন? ডায়েবেটিস রয়েছে। নোনতা খাবার চাই। শীতকালে কলকাতার বাজারে ভালো কাঁকড়া ওঠে। আর যদি একটু বিলেতি খাওয়া চাখতে চান তাহলে টার্কি। নিউ মার্কেট তো রয়েছেই।
৫) চড়ুইভাতি: পিকনিক বলুন বা চড়ুইভাতি - শীতকালে অন্তত একটিতে যেতে না পারলে বাঙালির যেন শীত করে না। কচুরি আলুরদম বা পাউরুটি দুটো ডিম আর একটা কলা - এই দিয়ে দিন শুরু করে মধ্যাহ্ন ভোজে কচি পাঠার ঝোল। বিকেলে বিস্কুট সহযোগে এক কাপ কফি বা চা খেয়ে বাড়ি ফেরা। সব মিলিয়ে ঠাসা বিনোদন প্যাকেজ। এই বিনোদনের রেশ চলবে পরের দিন অবধি। সহকর্মীদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগ না করতে পারলে পিকনিকের কোনও খাবারই যে হজম হবে না।
বছর বছর শীত পড়ুক কলকাতায়। আর বাঙালিও লেপ ত্যাগ করে গর্জে থুড়ি জেগে উঠুক। ওই যে বললাম শীতকালের কলকাতা সত্যিই অনন্য। ঘুম না ভাঙলে সবই তো মিস।
এত বড় রিস্ক নেওয়ার সাহস কিন্তু বাঙালির নেই।