কলকাতার আরও অনেক স্থাপত্যের মতই চৌরঙ্গী থিয়েটারের অস্তিত্ব এখন শুধুই বই-এর পাতায়
১৯৬৪ সালে, শেক্সপীয়ারের জন্মের ৪০০ বছর উপলক্ষে, থিয়েটার রোডের নাম শেক্সপীয়ার সরণি করা হয়
- Total Shares
বেঙ্গল এন্ড আগ্রা ডিরেক্টরি ১৮৫০ বলছে রাস্তাটির পুরোনো নাম ছিল "পুরানা নাচঘর কা উত্তর রাস্তা" । যে যুগের কথা হচ্ছে, তখন রাস্তার নাম আলাদা ভাবে দেয়া হতনা কলকাতায়। সেই রাস্তা দিয়ে যেখানে যাওয়া যায়, সেই জায়গার নামেই রাস্তার নাম হয়ে যেত। এই পুরানা নাচঘর ছিল আজকের শেক্সপীয়ার সরনী এবং চৌরঙ্গীর মোড়ে, আজ যেখানে সাহারা সদন। সেখান থেকে পূব দিকে লর্ড সিনহা রোড পর্যন্ত ছিল একটিই প্লট, এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে চৌরঙ্গী থিয়েটার, যার নামে রাস্তার নাম হয়ে যায় থিয়েটার রোড।
কলকাতা শহরে প্রথম সাহেবদের থিয়েটার লালবাজার স্ট্রিট আর মিশন রো-এর মোড়ের পূব দিকে তৈরী হয় ১৭৪৫ সালে। এই থিয়েটার, যার পরে নাম হয়ে যায় ওল্ড প্লে হাউস, সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মালিক, মিস্টার ফিঞ্চ সম্ভবত সেই যুদ্ধেই মারা যান, এবং পলাশীর যুদ্ধের পর, ওল্ড প্লে হাউস হয়ে যায় নিলামঘর। ১৭৫৬-এর সেই যুদ্ধেই মারা যান মিস্টার আয়ার এবং রাইটার্স-এর কাছেই যেখানে একসময় তাঁর বাড়ি ছিল, সেই জমিতেই ১৭৭৫ থেকে ১৭৭৬-এর মধ্যে গড়ে ওঠে ক্যালকাটা থিয়েটার, যাকে মানুষ নাম দেয়, নিউ প্লে হাউস। টিনের তলোয়ার যারা দেখেছেন বা শুনেছেন তারা গ্যারিকের নাম জানেন। আধুনিক থিয়েটার-এর প্রায় প্রত্যেকটি জিনিসের ওপরেই যার ছিল বিরাট প্রভাব, সেই ডেভিড গ্যারিক স্বয়ং তাঁর এক সহযোগীকে পাঠান ক্যালকাটা থিয়েটার-এর দায়িত্ব নিতে। কিন্তু, জনপ্রিয়তার দিক থেকে, সবাইকে ছাপিয়ে যায় চৌরঙ্গী থিয়েটার, বা দি প্রাইভেট সাবস্ক্রিপশন থিয়েটার।
থিয়েটার রোডের চৌরঙ্গী থিয়েটার এখন শেক্সপীয়ার সরণির সাহারা সদন [উপরের ছবি সৌজন্য: puronokolkata.com]
১৮১৩ সালের ২৫-এ নভেম্বর চৌরঙ্গী থিয়েটার-এর উদ্বোধন হয়। থিয়েটার তৈরী করার সমস্ত ব্যয় বহন করেন কলকাতার গন্যমান্য ব্যক্তিরা, শেয়ার-এর মাধ্যমে। ১০০ টাকা করে বিক্রি করা হয়েছিল এক একটি শেয়ার। বহু ইংরেজের সঙ্গে দ্বারকানাথ ঠাকুরও কিনেছিলেন চৌরঙ্গী থিয়েটার-এর শেয়ার। উদ্বোধনের রাতে খোদ বড়লাট সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। সেই সময়কার কলকাতায় সব থেকে বড় প্রেক্ষাগৃহ ছিল এই চৌরঙ্গী থিয়েটার। ৩০০ দর্শক এর বসার জায়গা ছিল ভেতরে। সে যুগে মেয়েদের অভিনয় করার রেওয়াজ ছিলনা। সাহেবদের নাটকেও, কম বয়েসী ছেলেদের মেয়ে সাজানো হতো। সেই রেওয়াজে প্রথম ব্যতিক্রম চৌরঙ্গী থিয়েটার, যেখানে মহিলাদের মঞ্চে দেখা যায় প্রথমবার। পেশাদার অভিনেতাদেরও এই মঞ্চেই প্রথম দেখা যায় কলকাতায়। হেনরি দি ফোর্থ, রিচার্ড দা থার্ড এবং দি মেরি ওয়াইভস অফ উইন্ডসর-এর মত শেক্সপীয়ার-এর অনেক নাটকই অভিনীত হয় চৌরঙ্গী থিয়েটার-এ। দ্বারকানাথ প্রেক্ষাগৃহের আধুনিকীকরণ করেন ১৮৩৫ নাগাদ, কিন্তু আগুনের হাত থেকে বাঁচানো যায়নি চৌরঙ্গী থিয়েটার-কে।
শেক্সপীয়ার-এর জন্মের ৪০০ বছর উপলক্ষে, কলকাতা কর্পোরেশন থিয়েটার রোডের নাম পাল্টে করে দেয় শেক্সপীয়ার সরণি
৩১-এ মে, ১৮৩৯। রাত ১-টা থেকে ২-টোর মধ্যে আগুন লাগে চৌরঙ্গী থিয়েটার-এ। মুহূর্তের মধ্যে আগুন লেলিহান শিখা গ্রাস করে গোটা প্রেক্ষাগৃহ। ঘটনাস্থলে দমকল পৌঁছয় খুব দ্রুত, কিন্তু আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনা ছিল প্রায় অসম্ভব। একে গোটা প্রেক্ষাগৃহ কাঠের তৈরী। তার ওপর ভেতরে মজুত রাখা সরঞ্জাম সবই দাহ্য। অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন দমকল কর্মীরা।রাট আড়াইটে নাগাদ বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ে থিয়েটার-এর গম্বুজ। বিদ্ধংসী আগুনের হাত থেকে প্রেক্ষাগৃহের একটি আসবাব পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
ক্যালকাটা থিয়েটার যেখানে ছিল, সেখানেই এখন এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের কার্যালয়
২৫-এ এপ্রিল ১৯৬৪-তে শেক্সপীয়ার-এর জন্মের ৪০০ বছর উপলক্ষে, কলকাতা কর্পোরেশন থিয়েটার রোডের নাম পাল্টে করে দেয় শেক্সপীয়ার সরণি। একসময় ক্যালকাটা থিয়েটার যেখানে ছিল, সেখানেই পরে তৈরী হয় Finlay Muir & Company-র অফিস। সেই বাড়ি আজও বর্তমান। এখন সেখানে এলাহাবাদ ব্যাংক-এর কার্যালয়। কিন্তু উইলিয়াম উড-এর আঁকা একটি ছবি ছাড়া, চৌরঙ্গী থিয়েটার-এর আর কোনো চিহ্ন বাকি নেই। কলকাতার আরও অনেক স্থাপত্যের মতই, তার অস্তিত্ব এখন শুধুই বই-এর পাতায়।