বিশ্ব ঐতিহ্যস্থলের তালিকায় থাকুক এ রাজ্যের ঐতিহ্যও, চাইছে হেরিটেজ কমিশন
অসাধারণ বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও স্থানগুলি বিবেচিত হওয়ার মতো অবস্থায় নেই কেন
- Total Shares
রাষ্ট্রসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন বা ইউনেস্কোর (UNESCO)বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল (World Heritage Site) তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের কোনও একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান বা স্থলের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য হেরিটেজ কমিশন রাজ্য সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কাছে প্রস্তাব রাখবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুনে উৎসাহিত বোধ করছি।
বিশ্ব ঐতিহ্যস্থলের গুরুত্ব কী? সেই তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য কেনই বা আমরা উৎসাহী এবং সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাপকাঠিই বা কী, কিংবা প্রক্রিয়াটি কতটা জটিল এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারনাটি খুব স্বচ্ছ নয়। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ সাধারণ মানুষের কথা ভেবে এই বিষয়ে কোনও লেখালিখি হয় না। বর্তমান প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য সহজ এবং সংক্ষিপ্ত ভাবে বিষয়টি আলোচনা করছি।
মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো: বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল
উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা যা পেয়েছি, যা আমাদের বর্তমান জীবনের অঙ্গ এবং যা আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে নিরাপদে তুলে দিতে চাই, সংক্ষেপে সেটাই হল ঐতিহ্য। ঐতিহ্য আমাদের জীবনের উৎস, অনুপ্রেরণা এবং অস্তিত্বের পরিচায়ক। এই সমস্ত ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থিত হোক না কেন সেটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অঙ্গ এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় সমগ্র মানবজাতির। এই ভাবনার বশবর্তী হয়েই ১৯৭২ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় যাবতীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক স্থানগুলিকে তালিকাভুক্ত করে তা সংরক্ষণের জন্য একটি চুক্তি বা প্রস্তাবনা গৃহীত হয়, যা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এক বিশেষ নিদর্শন। বর্তমানে বিশ্বের ১৯৩টি দেশ এই চুক্তিতে আবদ্ধ। আমাদের দেশ ১৯৭৭ সাল থেকেই এর সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত এবং ১৯৮৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সদস্য এবং বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিয়োজিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে – সাংস্কৃতিক (Cultural), প্রাকৃতিক (Natural) এবং মিশ্র (Mixed)। ঐতিহাসিক সৌধ, স্থাপত্যকলা, মূর্তি, চিত্রকলা, লিপি, গুহা-নিবাস প্রভৃতি কিংবা এগুলির একাধিক সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রত্নস্থল, যেগুলির ঐতিহাসিত, নান্দনিক, নৃতাত্বিক কিংবা বৈজ্ঞানিক কারণে বিশ্বজনীন আবেবদন রয়েছে, সেই ধরনের স্থানগুলিকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যময় স্থান হিসাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেণিভুক্ত হয়েছে সেই সমস্ত অঞ্চল বা তার অংশবিশেষ যেখানে প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক বা উদ্ভিদ জীবনের অংশ রয়েছে কিংবা সেই সমস্ত অঞ্চল যেখানে বিশেষ কোনও জীবজন্তু বা উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সেই অঞ্চল বা তার অংশ বিশেষের যদি বৈজ্ঞানিক, নান্দনিক এবং সংরক্ষণের কারণে বিশ্বজনীন আবেদন থেকে থাকে।
মিশ্র সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেই সমস্ত অঞ্চলকে যেখানে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে উপস্থিত। ১৯৯২ সালের সংশোধনীতে এই ধরণের স্থানগুলিকে সাংস্কৃতিক ভূ-দৃশ্য (natural landscape) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভূমিরূপের জন্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়নও বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল
রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী কোনও স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্তির আবেদন করার একমাত্র অধিকারী সেই বিশেষ রাষ্ট্র বা সরকার বা তাদের মনোনীত কোনও সংস্থা (আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণই এই বিষয়ে মূল ভূমিকা পালন করে থাকে)। প্রয়োজনে ইউনেস্কো সম্ভাব্য তালিকা প্রস্তুতিতে রাষ্ট্রগুলিকে সাহায্য করে থাকে। বর্মান নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ পরিস্থিতিতে কোনও রাষ্ট্রের তরফে অন্তত এক বছর আগে দাখিল করা সম্ভাব্য তালিকায় সেই বিশেষ স্থানটির উল্লেখ থাকলে তবেই তা বিশ্ব এতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর ১৯৯৮ সাল থেকেই সম্ভাব্য তালিকায় স্থান পেয়েছে।
বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চ, রাতের দৃশ্য
বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার অন্তর্গত হওয়ার জন্য যে কোনও প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সেটির বিশ্বজনীন আবেদন নিশ্চিত করার জন্য সাংস্কৃতিক বিভাগে ছ’টি এবং প্রাকৃতিক বিভাগে চারটি শর্ত (criteria) আরোপ করা হয়েছে। তালিকাভুক্তির জন্য এর মধ্যে অন্তত একটি শর্ত পূরণ আবশ্যিক।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য রাজ্য সরকারগুলি সরাসরি বা তাদের মনোনীত অন্য কোনও সংস্থা কিংবা কোনও বেসরকারি সংগঠনের তরফে এক বা একাধিক প্রস্তাব ভারত সরকার বা ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কাছে বিবেচনার জন্য পাঠান হয়ে থাকে।
কেন্দ্রীয় সরকার সম্ভাব্য তালিকা সংশোধনের আগে রাজ্য সরকার বা অন্যান্য সহযোগী সংস্থা বা সংগঠনগুলি যাতে সঠিক ভাবে প্রস্তাবটি পেশ করতে পারে সেই উদ্দেশ্য ২০১২ সালে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছিল। এই ধরনের একটি আঞ্চলিক ওয়ার্কশপে উপস্থিত থাকার সুবাদে লক্ষ্য করেছি প্রস্তাবক সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একান্তিক ইচ্ছা, পরিশ্রম এবং প্রস্তাবিত স্থানগুলির অসাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও সেগুলি বিবেচিত হওয়ার মতো অবস্থায় নেই। কারণটা সহজবোধ্য। এই ধরনের প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার জন্য প্রাথমিক ভাবে কী কী শর্ত পূরণ করতে হবে, কী ভাবেই বা অন্যান্য শর্ত পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে এবং কী ধরনের তথ্য ও অন্যান্য প্রামাণাদি দাখিল করতে হবে এ ব্যাপারে তাঁদের সম্যক ভাবে অবহিত করা হয়নি।
তাজমহল
ভবিষ্যতে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য তালিকায় কোনও ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রস্তাবকদের প্রথমেই বিবেচনা করতে হবে প্রস্তাবটি কোন শ্রেণিভুক্ত হবে, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক নাকি মিশ্র। প্রস্তাবিত স্থানটি বিশ্বজনীন আবেদনের স্বপক্ষে আরোপিত শর্তগুলির কোনটি বা কোন কোন শর্ত পূরণ করছে। সর্বোপরি সেই স্থান বা সৌধটি আদি ও অকৃত্রিম রূপেই আছে নাকি কোনও রকম অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ঘটেছে। স্থানটি সংরক্ষণের পক্ষে সহায়ক আইন আছে কিনা এবং থাকলে সেই আইনই যথেষ্ট কিনা কিংবা প্রয়োজনে নতুন বা সংশোধিত আইন বলবৎ করা সম্ভব কিনা।
স্থানটি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কাদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে (stakeholders)? কী ভাবে তাদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ে সুসংহত চিন্তাভাবনার পরেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ। প্রস্তাবের এই সমস্ত বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ-সহ যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে হয়। প্রস্তাবের স্বপক্ষে অবশ্যই দেওয়া হয় উঁচু মানের ফোটেগ্রাফ, ভিডিয়োগ্রাফ, ম্যাপ, ড্রয়িং, চার্ট প্রভৃতি যাতে প্রস্তাবটি সর্বার্থে গ্রহণযোগ্য হয়।
শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহ
পরিশেষে বলি, এই রাজ্যে যাঁরা বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করছেন এঁরা প্রত্যেকেই সুযোগ্য ও বিষয়টি সম্পর্কে সুশিক্ষিত এবং নিশ্চিত ভাবেই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি প্রণীত আইনসমূহ এবং সেগুলির সর্বাধুনিক সংশোধনী বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং কিছুকাল আগে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তরফে বিশ্বভারতী-শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা কেন সফল হয়নি সেটাও নিশ্চয়ই তাঁরা বিবেচনায় রেখেছেন।
অতএব আশা করা যেতেই পারে, যাবতীয় জটিলতা কাটিয়ে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের এই সদর্থক উদ্যোগ সফল হবে। এই রাজ্যের কোন ঐতিহ্যবাহী স্থান ভবিষ্যতে সারা বিশ্বের পর্যটককে আকর্ষণ করবে, এবং সেই সূত্রে আঞ্চলিক অর্থনীতিও খানিকটা উপকৃত হবে সেই আশায় আমরা সাধারণজনেরা বুক বাঁধলাম।