ভিএস নাইপলের মৃত্যুতে সাহিত্যের একটি যুগের অবসান ঘটলো
ওনার জন্মদিনের মাত্র কয়েকদিন আগে ১১ই অগাস্ট তিনি মারা গেলেন
- Total Shares
সমকালীন ইংরেজি লেখকদের মধ্যে খুব কম লেখকই আছেন যাঁরা লিখন শৈলীতে বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপলের (১৯৩২-২০১৮) মতো শৈলীক ও তীব্র ব্যঙ্গপূর্ণ দক্ষতা আছে।
তাঁর জন্মদিন ১১ই অগাস্ট, বেঁচে থাকলে ওনার বয়স হত ৮৬। তবে ওনার জন্মদিনের মাত্র কয়েকদিন আগে ১১ই অগাস্ট তিনি মারা গেলেন। উনি যে ধরনের লেখক ছিলেন এবং ওনার যে একটা ভিন ধরনের লেখার কায়েদা ছিল সেটা যেমন বিতর্কিত তেমনই তাঁর এই জাতিয় লেখা আর হয়েতো কেউ সৃষ্টি করতে পারবেন না।
ছবি:রয়েটর্স
তিনি যেমন ভাবে নিজের জীবনের সব ঘটনা এবং স্মৃতিগুলকে খুব পুঙ্খানপুঙ্খ ভাবে লিখে রেখেছেন অনেককেই নিজেদের জীবনের এমন বহু ঘটনা স্বীকারই করতে চাইবেন না, যেমন তাঁর জিবনে ব্যভিচারের ঘটনা, কখনও নিজের সঙ্গীর উপর বা কখনও নিজের স্ত্রীর উপর অত্যাচার করার ঘটনা, খুব অল্পতে রেগে যাওয়ার ঘটনা, বন্ধুদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ার ঘটনা, সবকিছু নিয়ে অসম্ভব কার্পণ্য ভাব দেখানো আবার কখনও মার্জিত ও ভদ্র ব্যবহার করা এবং মাঝেমধ্যেই দয়া-দাক্ষিণ্য দেখানোর স্মৃতি।
The end of a long tale: Paul Theroux helps push VS Naipaul's wheelchair @ZEEJaipurLitFes pic.twitter.com/Rj9cOtLoej
— William Dalrymple (@DalrympleWill) 24 January 2015
নাইপলের পুরো জীবনটা যেন দুটি অসম ভাগে বিভক্ত, প্রথমে ৩৫ বছর লড়াই আর পরের ৫০ বছর সাফল্য। তাঁর প্রথম জীবনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া লড়াই তারপর সেই লড়াই চলতে থাকে তিনি যখন অক্সফোর্ড-এ পড়াশোনা করার সুযোগ পেলেন তখন বি লিট-পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে না পারা এবং লন্ডন শহরে যখন একজন লেখক হিসেবে তিনি ব্যর্থ হন তখন নিজের দেশ ট্রিনিডাডে ফিরে জাওওার মতো পরিস্ততি হয়েছিল তাঁর।
এসব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে এবং পৃথিবীটাকে চিনেছিলেন। একটা জিনিস তাঁর সম্বন্ধে বলা চলে যেটা তাঁকে লেখক হিসেবে বড়বোনও করেছে আবার তাঁকে বাঁচিয়েছে তা হল নিজের পেশায় তাঁর অবিচল নিষ্ঠা। পাশাপাশি তাঁর খুঁতখুঁতে বাতিক তাঁকে তাঁর সময়েকার শ্রেষ্ঠ লেখক বানিয়েছিল।
ছবি:রয়েটর্স
তাঁর কাছে এই আধুনিক দুনিয়ার ন্যায়বোধ বিজ্ঞানচেতনা, পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ,মূল্যবোধ ও সাহিত্যমনষ্কতার ছিল অপরিসম এবং তিনি নিজেকে এই নব্য সমাজের অংশ বলে মনে করতেন। বিনিময় তাঁকে নিজের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরস্কারে সম্মানিত করেছে। তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর বই 'ইন এ ফ্রি স্টেট' বইটির জন্য বুকার পুরস্কার পান। এছাড়াও সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য ২০০০ সালে তিনি মহারানী এলিজাবেথের হাত থেকে নাইটহুড সম্মান পান। ২০০১ অক্টোবরের ১১ তারিখে তিনি ১০০তম নোবেল পুরস্কারটি পান।
নাইপলকে অনেককেই অপছন্দ করতেন, তাঁর সমবয়সীরা তাঁকে তেমন একটা পছন্দ না করলেও তাঁর সমালোচক এবং পাঠকরা তাঁকে পছন্দ করতেন। বর্ণবিদ্বেষের জন্য, কিছুটা নারী বিদ্বেষীর জন্য, ইসলামে তাঁর আতঙ্কের জন্য নিয়মিত ভাবে তাঁকে সমালোচিত হতে হত। পাশাপাশি তিনি একঘেয়েমি এবং তৃতীয় বিশ্বের সম্বন্ধে অর্ধসত্য কথাকে তোল্লাই দিতেন না। বিশ্বের বহু জায়গায় তিনি গেছেন এবং সে সব জায়গায়ে গিয়ে তিনি যেসব ভগ্ন এবং প্রায় ভগ্ন সমাজ ও জাতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন তাদের সম্বন্ধে তিনি যাযা লিখেছেন তা হয়তো অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয় তবে তাঁর লেখার মধ্যে কঠিন বাস্তব সত্যটাই প্রকাশ পেয়েছে।
অনেককেই মনে করেন যে তিনি ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা অত্যন্ত ঘৃণ্য। তিনি বলেন, “ইসলাম ধর্মে ও আরবে সাম্রাজ্যবাদ ঠিক যেমন ছিল তেমনটা বোধহয় আর কোথাও নেই। এবং যাঁরা অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে গেছেন তাঁদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ধর্মান্তরিত হতে গেলে একজন ব্যক্তিকে তাঁর পূর্ব জীবনের সব ঘটনাকে ধ্বংস করে দিতে হয়। সেগুলোকে মাড়িয়ে ফেলে এবং নিজের পূর্বপুরুষদের ধর্ম বা সংস্কৃতিই ছিল না বা সেটা তাঁদের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়।” আমার মনে হয় উনি ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছেন। যেসব বড় ধরণের বিপদের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়েছে তাঁরা কিন্তু কেউ ধর্মান্তরিত মুসলমান নন অর্থাৎ ইরানের মুসলমানরা কিন্তু এইসব বিপদ ঘটানোর জন্য দায়ী নয়। বরং বিপদের জন্য দায়ী হল আরব ভূখন্ড- আল কাইদার জন্মস্থান এবং আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান যেটি তালিবানের আস্তানা।
ওঁনার সেরা কাজ 'এ হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাস (১৯৬১) নিঃসন্দে এই শতাব্দীর একটি অন্যতম শ্রেষ্ট উপন্যাস। নির্বাসন
অনেকের মতে তাঁর লেখা শ্রেষ্ট বইটি হল 'এ হাউসজ ফর মিস্টার বিশ্বাস' এই বইটিকে শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ট বই বললে অতিরিক্ত বলা হবে না। বইটিতে হতাশা, দুঃখ, হারানোরর যন্ত্রনা, পুনরায় ফিরে পাওয়া -এই সবকিছুকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি আধুনিক মহাকাব্য। এক প্রায় হাস্যকর কেন্দ্রীয় চরিত্রের এই কঠিন ও সমস্যাকীর্ন পৃথিবীতে খাপ খাইয়েই নেওয়ার আখ্যানের পাশাপাশি এক কাব্যিক ও রাজনৈতিক রূপক উপন্যাসটি ভারতীয় ডায়াস্পোরার বঞ্চনা, দুঃখ, নিপীড়ণের এক ঐতিহাসিক দলাল। এই উপন্যাসটির প্রায় আধুনিক রসায়ন হলেও লেখক মর্যাদা পুরুষত্বম রামচন্দ্রের স্থানে এক প্রতি নায়ককে বসানোর সাহস দেখিয়েছেন।
বিশ্বাস হল ভারতীয় সভ্যতার অস্তিত্ব ও বিস্তারের কাহিনী। যা নাইপোলের অভিজ্ঞতার ফসল। বইটি শুধু নাইপলের রচনার একটি উলেখযোগ্য অংশই নয় বইটি আসলে আধুনিক লেখকের প্রস্তুতি পর্বের এক দলিল। নাইপলের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাঁর টালি টালি গড়ে তোলা শানিত ও দক্ষ কারিগরির পাশাপাশি তাঁর দাম্ভিক সংস্কার, কয়েকটি ভুল ধারণা, ও কঠোর চিন্তাধারাও রচিত বিখ্যাত উপন্যাসগুলিকে প্রভাবিত করেছিল। নাইপলের মতামত বা চিন্তাধারার সঙ্গে হয়তো আমরা সবসময় একমত হতে পারি না, তবু একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে তাঁর লেখা বইগুলি অসম্ভব ভালো।
আমার সঙ্গে নাইপলের সঙ্গে পরিচয়টা খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে হয়।
একবার দিল্লির কয়েকজন লেখক ও বুদ্ধিজীবী নাইপল এবং ওঁনার স্ত্রী নদীরা অর্থাৎ লেডি নিপলের সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ পেল সেই দলে আমিও ছিলাম। সালটা ছিল ২০০৪ আর তারিখটা ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারী। ওঁনার সঙ্গে বৈঠকের দিন ঠিক হল। বৈঠকের স্থানটা ছিল খুবই অদ্ভুত। এনডিএ সরকারের আমল তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। অশোক রোডে বিজেপির প্রধান পার্টি অফিসে নাইপলের সঙ্গে আমাদের বৈঠকের স্থান ঠিক হল। বহু গন্যমান্য রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতা করলেন। তাঁরা তাঁদের বক্তৃতা বেশি দীর্ঘায়িত না করলেও বক্তৃতাগুলোর মনে তেমন কোনও দাগ কাটতে পারলো না। বেশ কিছু পরে একটি রসাত্মক ও বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনতে পাওয়া গেল। “আপনি কি বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা কে সমর্থন করেন? উত্তরে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমি সমর্থন করেছিলাম...এবং আমি অনেকবার করেছি।” ওপর এক ব্যক্তি এস ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বিজেপি কী আপনাকে কোনও আর্থিক সহায়তা করছে?” উত্তরে স্যার ভিদিয়া একটা চতুর হাঁসি দিয়ে বললেন, "আমার তাতে কোনও রকম অসুবিধা নেই।"
তবে সেদিন দুপুরে ভালো লাগার মতো আর যে কিছু হতে পারে সে আশা আমি একরকম ত্যাগ করেছিলাম।
এ হাউজ ফর মিস্টার
সবার সঙ্গে বৈঠক সারার পর, লেডি নাইপল বললনে যে আমাদের যে দলটি ওখানে গিয়েছিলো তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে পরিচয় করতে চান। ওনার সঙ্গে দেখা করব বলে আমরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালাম। সবাই এক-দু মিনিট করে ওনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেল।আমি ওনার লেখা দুটো বই আমার সঙ্গে নিজে গিয়েছিলাম-এ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস (১৯৬১) ও 'আমং দা বিলিভার্স' (১৯৮১) অনেকের মতে 'আমং দা বিলিভার্স' বইটির মাধ্যমে জীবনে প্রথমবার তিনি ইসলাম ধর্মের আসল ও অন্তর্নিহিত মানেটা খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। আমার যখন ওনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পালা এল আমি ওনাকে বললাম যে আমি ওঁনার লেখার কত বড় একজন অনুরাগী। তারপর আমি ওনার লেখা বই দুটো ওঁনার সইয়ের জন্য সামনে মেলে ধরলাম ও ওনাকে একটা সই দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম।
নাইপুল খুব একটা লম্বা চেহারার মানুষ ছিলেন না, বড় জোর ৫'৫'' হবে। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুটা গর্বিত হয়েই বললেন, "আমি শুধু মাত্র নতুন ও শক্ত মলাটে বাঁধান বই সই করি।" আমার দুটো বই-ই ছিল পুরোনো এবং সেগুলো বাঁধানোও নয়। আমার পুরোনো 'মিস্টার বিশ্বাস'-টি খুলে তার প্রথম পৃষ্টার উপর আটকানো সার্টিফিকেটটি দেখলাম লেডি নাইপলকে দেখলাম। "সার্টিফিকেটটির উপরে লেখাছিল বইটি দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজে ১৯৭৮ সালে প্রথম বর্ষের বিএ ইংরেজি (অনার্স)-এর পরীক্ষায় আমি সব চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছি বলে এমএম ভাল্লা পুরস্কার স্বরূপ বইটি আমাকে দেওয়া হল।"
লেডি নাইপল বললেন, “২৫ বছর ধরে ও পৃথিবীর যেখানে গেছে সেখানেই এই বইটিও সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। কি দারুন ব্যাপার।” কথাটা শুনে নাইপল একটা উষ্ম হাসি হাসলেনন যার ফলে তাঁর চোখ দুটো একটু ছোট হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখে চারপাশের বলিরেখাও আরও স্পষ্টভাবে দেখা দিল। তিনি বললেন, "আচ্ছা, তাহলে..."
বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল
নিজের দামি কালির কলমটি কিঞ্চিৎ ঝাকিয়ে নিয়ে তিনি খসখস করে সই করলেন।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন