সোশ্যাল মিডিয়ার একঘেঁয়েমি কাটাতে আমরা হিন্দুত্বের জন্য কী করতে পারি
১৯৪৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ফিরেছে এক ডজন মূর্তি, তার পরে ফিরেছে ২৭টি
- Total Shares
বহু বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নামকরা জাদুঘরে সপ্তদশ শতকে তৈরি একটি গণেশের মূর্তি দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম, কারণ ওই মূর্তির উপরে সিঁদুর ও চন্দনের দাগ স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছিল।
আমি একজন কিউরেটরকে ডেকে বললাম যে, মূর্তিটিতে এখনও পুজোর চিহ্ন স্পষ্ট, যদি মূর্তিটি চুরি করা না হয়ে থাকে তা হলে মূর্তিটি সম্ভবত বেআইনি ভাবে অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
নিদর্শনটি আসল তা নিশ্চিত করার জন্য পাচারকারীরা তো বটেই, ওই জাদুঘরের কিউরেটরও নিদর্শনের প্রতিটি নিশানা অত্যন্ত যত্ন করে রক্ষা করেছিলেন। এ জন্য তাঁদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
অসহায় ভাবে সেই কিউরেটর বললেন, “অতশত বলতে পারব না, আমরা একটা কথাই বলতে পারি যে আমরা নিলামে যোগ দিয়েছিলাম এবং দাম চুকিয়ে এটি কিনেছি।”
Jains also celebrate the festival of light. This statue represents a ‘tirthankara’ – one who has liberated themselves from the cycle of rebirth. Diwali commemorates the final liberation of the soul of Mahavira, the 24th tirthankara https://t.co/9MTw5yB9zp pic.twitter.com/AifsUDME7H
— British Museum (@britishmuseum) November 7, 2018
ইতিহাস সংরক্ষণ
ভারতীয় বহু দেবদেবীর এটাই ভবিতব্য – স্থানচ্যুতি, চুরি, চোরাচালান, পাচার, অমর্যাদা এবং জনসমক্ষে প্রদর্শন।
নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল, খুব হতাশও লাগছিল।
তার পরে ইন্ডিয়া প্রাইড প্রজেক্ট (আইপিপি) শুরু হল।
আমাদের দেশের চুরি যাওয়া মূর্তির ব্যাপারে সারা বিশ্বই যথেষ্ট মাত্রায় সচেতন (ছবি: পিটিআই)
সমকামী নারী, সমকামী পুরুষ, উভকামী, রূপান্তরকামী এবং উভলিঙ্গদের (এলজিবিটি) নিয়ে মহান উদ্যোগগুলির কথা লোকে জানলেও বেশিরভাগ লোকই এই আইপিপি সম্বন্ধে একেবারেই জানেন না।
যে সব মানুষ বৈষম্যের শিকার বা যে সব মানুষ বঞ্চিত তাদের জন্য অবশ্য আইপিপি লড়াই করে না, তারা লড়াই করে সেই সব ভগবানের জন্য যাঁদের হরণ করে পাচার করে দেওয়া হয়েছে।
আইপিপি হল ভারতের দেবদেবী এবং ওই ধরনের সব মূর্তি যাতে আবার ভারতে ফিরে আসে সে জন্য তৈরি হওয়া আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। পাচার হয়ে যাওয়া দেব এবং দেবীকে উদ্ধার করা – এর থেকে মহান ও ধার্মিক কাজ আর কী হতে পারে?
সাফল্যের সম্ভাবনা নেই বা আত্মঘাতী আর পাঁচটা দক্ষিণপন্থীদের থেকে একটু ব্যতিক্রমী ভাবেই সারা দুনিয়া স্বীকৃতি পেয়ে গেল আইপিপি এবং সাফল্যও পে, জাতীয় স্তরেও তারা নজর কাড়ল এবং সমর্থনও পেয়ে গেল।
আইপিপি-র হস্তক্ষেপ অনেক বেশি করেই উল্লেখের দাবিদার এবং সময়োচিত, কারণ একদিকে সারা বিশ্ব জুড়ে হিন্দুত্বকে লাঞ্ছিত হচ্ছে এবং অন্য দিকে সারা বিশ্বের চোরাচালানের বাজারে এই ধর্মের মূর্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আইপিপির উদ্দেশ্য হল সেই হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করা এবং একই সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি সম্বন্ধে লোকজনকে আরও বেশি করে অবহিত করা। হালকা করে একবার ইন্টারনেটে সার্চ করলেই জানা যাবে আইপিপি কী ভাবে কাজ করে চলেছে আর তাদের কাজের মূল্য কী অপরিসীম।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ বিশ্বের তাবড় নেতাদের সঙ্গে উদ্ধার হওয়া ভারতীয় শিল্পকলার ও মূর্তির ছবি এবং একই সঙ্গে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে তার প্রচার – এটা হল সাফল্যে ছোট্ একখণ্ড চিত্র মাত্র। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাকুল্যে এক ডজন বা তার কাছাকাছি সংখ্যার মূর্তি ভারতে ফেরত এসেছিল, তবে ২০১৪ সাল থেকে ২৭টি মূর্তি ভারতে ফেরত এসেছে। এই সংখ্যাটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ হলেও এর প্রতীকি যে অর্থ রয়েছে তা অপরিমেয়, হয়তো যত সংখ্যক মূর্তি ও ঐতিহ্যের নিদর্শন উদ্ধার হয়েছে তার চেয়ে এর মূল্য অনেক অনেক বেশি।
প্রতিটি মূর্তি চুরির পিছনেই থাকে বলার মতো একটি রোমাঞ্চকর কাহিনি যা গুছিয়ে বলা যেতে পারে (ছবি: এপি)
ঈশ্বরের ঘরে ফেরা
পরেরটায় রয়েছে বিখ্যাত নটরাজ বা নৃত্যরত শিব, মূর্তিটি ব্রোঞ্জের তৈরি, দাম হবে ৫০ লক্ষ ডলার, এটা ন্যাশনাল গ্যালারি অফ অস্ট্রেলিয়ায় (এনজিএ) এজিএ যখন ওই চোরাই শিবমূর্তিটি জনসমক্ষে প্রদর্শিত করতে অস্বীকার করল আইপিপি তখন একটি ছবির সঙ্গে মূর্তিটির তুলনা করল এবং প্রমাণ করে দেখাল যে দুটি মূর্তিই এক এবং অভিন্ন।
এই ঘটনার কথা পরিকল্পনামাফিক প্রচার করা হল, সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে ক্যাম্পেন করা হল, যার ফলে এনজিএ কিছুটা লজ্জিতও হয়ে পড়ল এবং এটা ফেরত দিতে রাজি হয়ে গেল। মূর্তিটি আসলে যে মন্দিরে ছিল, এই মূর্তিটি না থাকায় সেই মন্দিরও অবহেলার শিকার হয় এবং কালে কালে জীর্ণ হয়ে পড়ে, সেটিরও সংরক্ষণ ও সংস্কার করা হয়। এই মূর্তিটি চুরি করেছিলেন সুভাষ কাপুর নামে এক ব্যক্তি যিনি ম্যানহাটনের একজন বাসিন্দা শিল্পকরার ব্যাপারি তবে অনেকেই তাঁকে চোর ও চোরাচালানকারী বলে থাকেন। সুভাষ কাপুর আপাতত জেলে, তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে যার ডাকনাম হল ‘অপারেশন হিডন আইডল’।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হল খুব ছোট আকারের হলেও দ্বাদশ শতকের নালন্দা বুদ্ধ। ১৯৬১ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা এএসআই) জাদুঘর থেকে আরও ১৩টি মূর্তির সঙ্গে ফেরত আনার সময় এই মূর্তিটি চুরি হয়ে যায় এবং দেখা যায় লন্ডনের একটি নিলামে। মূলত আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন মহানির্দেশক শচীন্দ্রশেখর বিশ্বাস এই মূর্তিটির ছবি তুলিয়ে রাখিয়েছিলেন বলেই নালন্দা বুদ্ধকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় এবং সেটিকে উদ্ধার করা যায়।
হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী প্রত্যেক দেবদেবীই ব্যক্তিস্বরূপ-স্বরূপা, তাই প্রতিটি মূর্তি চুরির ঘটনার নেপথ্যেই এক একটি করে গল্প রয়েছে, কখনও সেই কাহিনি দুর্দান্ত আবার কখনও সেই কাহিনি গল্প করার মতো রোমাঞ্চকর। সে যাই হোক, আইপিপি-র এই অসামান্য উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্বব্যাপী ভারতীয় দেবদেবীর অন্যান্য মূর্তির ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এমনকি যাঁরা ব্যক্তিগত সংগ্রাহক তাঁরাও এখন কোও মূর্তি কেনা বা সংগ্রহের আগে সেটির আইনি দিন ও যাথার্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছেন।
অন্য শক্তি
আইপিপির বিপুর সাফল্যের বিচার আরও এক ভাবে করা যেতে পারে, সংসদের ভিতরে ও বাইরে -- দু’জায়গা থেকেই তাদের সমর্থন মিলছে, শুধু বিজেপি এবং কংগ্রেস-ই নয়, এডিএমকের মতো দক্ষিণ ভারতীয় দলটির মতো বেশিরভাগ আঞ্চলিক দলেরও তারা সমর্থন পাচ্ছে। একই ভাবে মূলধারার গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া, দুই ধরনের মাধ্যমই আইপিপি-র উদ্যোগকে সমর্থন করছে।
এই উদ্যোগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অনুরাগ সাক্সেনার কথায়, “যেখান থেকে মূর্তিটি চুরি গিয়েছিল আবার সেখানে সেই মূর্তিটি ফিরিয়ে দেওয়াই নয়, ভারতের সফট পাওয়ার বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠাও এই এই প্রচেষ্টাকে আরও উজ্জেবল করেছে।” সিঙ্গাপুরে কর্মরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং এমবিএ ধারী অনুরাগ সাক্সেনা জোর দিচ্ছেন ভারত থেকে চুরি যাওয়া মূর্তি ফেরানোর উপরে, তিনি তা নিয়ে সওয়াল করছেন এবং লোকজনকে সচেতন করছেন। যখন অনুরাগ কাজের মধ্যে নেই তখন হয়তো দেখা যাবে যে তিনি কোনও কমেডি শোয়ে রয়েছেন অথবা গাড়ি চালাচ্ছেন।
দক্ষিণপন্থীদের অনেক বিষয়ে এবং অনেক পদ্ধতি নিয়ে ধ্যানধারনা থাকতে হয়: তিনি বললেন, “ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে। মনে করুন যখন অ্যাঞ্জেলা মর্কেল” এবার একটু থামলেন, তারপরে মুচকি হেসে আবার করলেন, “জনসমক্ষে মূর্তিটি প্রধানমন্ত্রীকে হস্তান্তর করলেন। তার মানে তিনি বলতে চাইলেন যে দেখো বাবা, ভারতে ফেরত নিয়ে গিয়ে আবার জগাখিচুড়ি কাণ্ড বাধিও না যেন!”
নীতি নির্ধারণ, সংসদীয় ও বিচারবিভাগীয় পদ্ধতি মেনে টানা যথাযথ ভাবে কাজ করে যাওয়া এবং একই ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া পুরো ব্যাপারাটি তুলে ধরে তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া – শুধুমাত্র শুরুটা করে মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া নয়, নিরন্তর এ জন্য কাজ করে করে যাওয়া – পাচার হওয়া মূর্তি ফেরানোর জন্য।
শুধুমাত্র হিন্দুদের কথা ভেবে এই উদ্যোগ বলে কেউ যদি মনে করেন তবে তা হবে আত্মহত্যার সামিল।
(সৌজন্য: মেল টুডে)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে