নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে তনুশ্রীর তোলা অভিযোগ নিয়ে বলিউড আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব
সাহসিকতার জন্য তনুশ্রীকে বাহবা দেওয়া মানে নানাকে দোষী বলা নয়
- Total Shares
পদ্মশ্রী নানা পাটেকর সবকিছুই যা তনুশ্রী দত্ত নন।
নানা পুরুষ, আঞ্চলিক ছবিতে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সুপারস্টার, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা এবং বলিউডের প্রাক্তন সুপারস্টার। এ ছাড়াও দানশীল হিসাবেও দেশবিদেশে তাঁর পরিচিত রয়েছে। এমনকি এখনও মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক বৃত্তে তিনি সম্মানীয় ব্যক্তি, অনেক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
হর্ন ওকে প্লিজ ছবির সেটে ২০০৮ সালে অসম্মানজনক ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন তনুশ্রী দত্ত
অন্যদিকে তনুশ্রী হলেন জামশেদপুর থেকে আসা এক মহিলা যিনি ২০০৪ সালে মিস ইন্ডিয়া খেতাবের জন্য এসেছেন। মিস ইন্ডিয়া খেতাবের জোরেই তিনি বলিউডে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন। বলিউডে যদি বহিরাগত বলে কোনও বিভাজন করা হয় তা হলে তনুশ্রীর ক্ষেত্রে প্রতিটি ঘরেই টিক দিতে হবে।
নানা পাটেকর একেবারেই নাচতে পারেন না। আমি বলতে চাইছি তিনি একসঙ্গে টানা দু’টি স্টেপ পর্যন্ত করতে পারেন না, দরকারে ইউটিউবে কয়েকটি ভিডিয়ো দেখে নিতে পারেন, তা হলেই বুঝতে পারবেন যে আমি কী বলতে চাইছি।
তারপরেও ২০০৮ সালের হর্ন ওকে প্লিজ নামে একটি ছবির গানকে ঘিরে নানা পাটেকরকে নিয়ে যৌন হেনস্থার অভিযোগ নিয়ে ফিসফিসানি চলছে। এমনকি এই গানে নানা পাটেকরকে সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাচ্ছে তবে এই গানে বেশ খানিকটা অংশ পুরুষকণ্ঠেও গাওয়া হয়েছে।
২০০৮ সালে তনুশ্রী দত্তের অভিযোগ ছিল, যে অভিযোগ তিনি আবার এক দশক পরে করছেন, তা হল যে ওই গানের সময় নানা পাটেকর তাঁর হাত টেনে ধরে নাচের কয়েকটা স্টেপ শেখাতে চেয়ে ও উৎসাহদানের অছিলায় তাঁকে যৌনহেনস্থা করেন।
নানা পাটেকর নাচের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন! এটা আমার কাছে বিশ্বাস করুন বা না করুন (বিলিভ-ইট-অর-নট) ধরনের একটা ব্যাপার।
বিষয়টি চরমে উঠল যখন তনুশ্রী বললেন তিনি তাঁর ওই অত্যুৎসাহের প্রতিবাদ করেন। তাঁর অভিযোগ যে তাঁর সমস্যা এখানেই শেষ হয়নি, নানা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি নাচের দৃশ্য চাইছিলেন, যার জেরেই শেষ পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা তিনি ভ্যানিটি ভ্যানে কাটাতে বাধ্য হন।
তবে হে ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, তাঁর সঙ্কট এখানেও শেষ হয়নি। সংবাদমাধ্যমে তাঁর বয়ান অনুযায়ী, সংবাদবাধ্যমকে ওই সেটই ডাকা হয় এবং তাঁর সম্বন্ধে বলা হয় যে তিনি তিনিই নায়িকা কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না। তনুশ্রী বলেন যে মা-বাবার সঙ্গে তিনি তিনি সেট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই বেরনোর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে ডাকা হয়। তাঁরা তনুশ্রীর গাড়ির কাচ ভেঙে দেন এবং পুলিশ শূন্যে গুলি ছুড়ে তাঁকে উদ্ধার করে।
অভিযোগ জানাতে যখন তনুশ্রী থানায় যান তখন তিনি দেখেন যে নানা পাটেকর আগেই তাঁর নামে এফআইআর করে দিয়েছেন।
তনুশ্রী বলেছেন যে কোরিয়োগ্রাফার গণেশ আচার্যকে এ ব্যাপারে বলা হলে তখনি তিনি পুরো ঘটনার কথা অস্বীকার করেন, তিনি বলেন যে তিনি ঘটনার কথা ঠিকমতো মনে করতে পারছেন না তবে তিনি নিশ্চিত যে যৌনহেনস্থার কোনও ঘটনা ঘটেনি। তনুশ্রী বলেন যে কোরিয়োগ্রাফার হিসাবে ওই নাচের দৃশ্যে তিনি গণেশ আচার্যকে তিনিই বেছেছিলেন।
২০০৮ সালে যিনি সাংবাদিকতায় নতুন মুখ ছিলেন, এখন বরিষ্ঠ বিনোদন সাংবাদিক জেনিস সেকুইরা টুইটারের থ্রেডে নিজেকে ওই ঘটনার সাক্ষী হিসাবে দাবি করেছেন। তিনি যে বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন তা হল – এক দশক পরেও তনুশ্রী তাঁর বয়ানে বিন্দুমাত্র বদল ঘটাননি। তিনি তনুশ্রীর হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান করেছেন।
Some incidents that take place even a decade ago remain fresh in your memory. What happened with #TanushreeDutta on the sets of “Horn Ok Please” is one such incident - I was there. #NanaPatekar[THREAD]
— Janice Sequeira (@janiceseq85) September 26, 2018
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, এটাই হল ওই ঘটনার গুঞ্জনের কারণ। কিন্তু এই কথা কেউ শুনতেই পাচ্ছেন না, সকলেই যেন বধির হয়ে গেছেন।
আশ্চর্যজনক ঘটনা হল, এই অভিযোগ ওঠার ঠিক আগে মিটু (#MeToo) নিয়ে বলিউডে অনেক আলোচনা হচ্ছিল এবং বলা হচ্ছিল যে এখানে কোনও দিনই মিটু হবে না, কারণ একানের কোনও অভিনেত্রীরই বড় তারকা ও প্রযোজকের বিরুদ্ধে কোনও কিছু বলার মতো সাহস নেই।
ঘোরতর ভাবে যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটলেও কেন বলিউডে মিটু আন্দোলন শুরুই হবে না তা নিয়ে অনলাইন নিবন্ধ লেখা হয়েছে, টেলিভিশনে বিতর্কও হয়েছে। কয়েকজন অভিনেত্রী অবশ্য এগিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ঘটা যৌনহেনস্থার কথা বলেছিলেন, তবে তাঁরা কারও নাম করেননি, আর তাঁদের ওইসব ভিডিয়ো হাজার হাজারবার দেখা হয়েছে। কিন্তু কাউকেই কোনওরকম অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি, কারণ কেউই কোনও নাম করে কাউকে লজ্জায় ফেলেননি। যখন কোনও নামই উঠে আসেনি, তখন এ নিয়ে বিতর্কে কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু তনুশ্রী সেই ঘেরাটোপ থেকে বার হয়ে নাম করেছেন, তাতেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সাহসে ভর করে যখন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে পুরনো এক অভিনেত্রী পুরোনো কথা আরও একবার বলার সাহস দেখালেন এমনকি যিনি তাঁকে হেনস্থা করেছেন তাঁর নাম পর্যন্ত এক সময় বললেন তখনও সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি লজ্জিত হলেন না। সে কথা না হয় ভুলেই গেলেন, কিন্তু কেউই তাঁর অভিযোগে কান দিলেন না। কোনও তদন্তও হল না।
কাদায় তরঙ্গ তুলে লাভ নেই, তা অচিরেই থেমে যাবে। বলিউডের ধ্বজাধারীরা এ সব নিয়ে হইচই বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন এবং সে সব থিতিয়ে গেলে তাঁরা আবার নিজেদের ছবি নিয়ে কথাবার্তা বলা শুরু করবেন।
এর মধ্যে অবশ্য তাঁরা কেন এ ব্যাপারে কোনও কথা বলবেন না তার নানা কারণ তাঁরা ব্যাখ্যা করে দেবেন।
নানা পাটকরের বিরুদ্ধে এর আগে কোনও বলিউড-তারকা কোনও অভিযোগ করেননি (সৌজন্য: টুইটার)
“আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না”, “আইন আইনের পথে চলবে”, “সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই”, “আমি এই ব্যাপারটা ঠিক জানি না”, “বিষয়টা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানছি”, “আমি নারীর অধিকারে বিশ্বাস করি, এ ব্যাপারে আমাকে কোনও প্রশ্ন করবেন না”, “আমি এখন আমার আগামী ছবি নিয়ে কথা বলতে পারি?” এবং “কোনও মন্তব্য করব না” গোছের কয়েকটি গতে বাঁধা উত্তর পাওয়া যাবে।
এই পেশায় এমন একজনও নেই, আবার বলছি এমন একজনও নেই যিনি তনুশ্রী দত্তের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসবেন। মনে রাখবেন, তনুশ্রীকে নীতিগত ভাবে সমর্থন করার অর্থ এই নয় যে আপনি বলছেন যে ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিল এবং নানা পাটেকর সত্যিই দোষী।
বলিউডের ধ্বজাধারীরা নির্বিকার ভাবে মুখে কুলুপ এঁটে থাকবেন এবং এমন ভান করবেন যেন এই ধরনের কোনও ঘটনাই সেখানে ঘটে না।
জানেন কেন তাঁরা এমন করবেন? কারণ একজন একাকিনী নারী দাঁড়িয়েছেন একজন প্রভাবশালী পুরুষের বিরুদ্ধে। বলিউডে যে নারী বিস্মৃতপ্রায় হয়ে গেছেন তিনি আবার উদিতা হবেন। একজন মহিলা যাঁকে জোর করে তাঁর পেশা থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল তিনি পালে হাওয়া পেয়ে যাবেন। যে বিচার ওই নারী চাইছেন সেই বিচার যদি তিনি পান তা হলে প্রতিদানে তিনি কিছুই দিতে পারবেন না। তাঁর পাশে দাঁড়ানো কাউকেই তিনি কিছু দিতে পারবেন না।
এই মিটু আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। তবে ইতিহাস মনে রাখবে যে তাদেরও যে মেরুণ্ড আছে তা দেখানোর একটা সুযোগ বিশ্বের বাকি অংশের মতো বলিউডের সামনেও এসেছিল। তবে সে অমেরুদণ্ডীর মতো আচরণ করেছিল।
অত্যন্ত ক্ষমতাশালী চলচ্চিত্রনির্মাতা হার্ভে ওয়েইনস্টেইেনর বিরুদ্ধে যখন একের পর এক হলিউড অভিনেত্রী মুখ খুলতে শুরু করেন তখন মিটু আন্দোলন গতি পেয়েছিল। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি নিবন্ধে যখন হার্ভে ওয়েইনস্টেইনকে যৌনশিকারী হিসাবে তুলে ধরে তখন সেই অভিযোগ যে সত্যি তা তুলে ধরার জন্য এগিয়ে আসেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, গোয়েনেথ প্যালট্রো, সালমা হায়েক প্রমুখ। মহিলারা যখন একে অপরের পাশে দাঁড়াতে শুরু করলেন এবং প্রকাশ্যে এ নিয়ে বলতে লাগলেন তখন তা অন্য মাত্রা পেয়ে গেল। এই আন্দোলন এমন মাত্রায় গেল যা হলিউড আগে কোনওদিন দেখেনি।
কয়েকটি কারণে এটা হওয়ারই ছিল কারণ মিটু আন্দোলন নিয়ে বলিউড যা করেছে ওরা তার উল্টোটাই করেছিল।
কেউ কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থা নিয়ে বলার সাহস পায় না এমন নয়, আসল কথাটা হল কেউ যদি সাহস করে তাঁর হেনস্থার অভিজ্ঞতার কথা বলেন তা হলে এমন কোনও লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি মেরুদণ্ড সোজা রেখে তাঁর পাশে দাঁড়াবেন।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে