শতরঞ্জ কে খিলাড়ির সেটে সত্যজিৎ কেমন ছিলেন
সত্যজিতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল একমাত্র হিন্দি ও উর্দু ভাষার ছবি
- Total Shares
পেশাজীবনের বেশ অনেকটা সময় স্বল্প বাজেটের আর্ট-ফিল্ম বানাতে বানাতে কী ভাবে মাত্র কয়েকটা টেকে একটা গোটা সিনেমা বানিয়ে ফেলা যেতে পারে, সেই কৌশলটা সত্যজিৎ রায় বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত করেছিলেন। শুধুমাত্র সঠিক পরিকল্পনার দ্বারা কোনও রকম মহলা ছাড়াই একটি দৃশ্য তিনি শুট করতেন যাতে সেই দৃশ্যে অভিনেতাদের স্বতঃস্ফূর্ততা বজায় থাকে ও দৃশ্যটি অনেক বেশি বাস্তব হয়ে ওঠে। যদিও 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' ছবিতে অভিনেতাদের পেশাদারিত্বের জন্য তাঁদের বেশি টেকের প্রয়োজনও হয়নি।
অভিনেতাদের নিজেরদের মতো করে অভিনয় করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেন মানিকদা। সিনেমায় জেনারেল আউট্রামের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রিচার্ড আটানবরো। আউট্রামকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অভিনেতা রিচার্ড আটানবরো জানতে পারেন যে আউট্রাম সাহেব চুরুট খেতেন ও নাকের উপরে একটি ডাঁটিবিহিন চশমা পড়তেন। তাই, তিনি যেমন একজন স্কটিশ লোকের মতো কথা বলা অভ্যাস করতে শুরু করলেন তেমনই চরিত্রটি করার সময় সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন সব জিনিসপত্রও আটানবরো নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
রিচার্ড আটানবরো কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছে সত্যজিৎ রায়কে বলেন যে তিনি এই জিনিসগুলো নিয়ে এসেছেন। একই সঙ্গে তিনি এও বলেন যে, "সত্যজিৎ তুমি যেহেতু এই সিনেমার পরিচালক তাই তুমি ঠিক যেমনটা বলবে আমি তেমনটাই করব।" কিন্তু সত্যজিৎ রায় বলেন গবেষণায় আউট্রামকে সম্পর্কে যদি এমনটাই জানা যায় তাহলে আমরা খুব স্বচ্ছন্দে এইগুলো ব্যবহার করতে পারি। তাই তাঁর আউট্রামকে নিয়ে গবেষণা করে যে তথ্য উঠে এসেছে সেগুলো সিনেমায় ব্যবহার করা যাবে শুনে রিচার্ড আটানবরো খুব খুশি হয়েছিলেন। ঠিক একই ভাবে সিনেমার অভিনেতা সাঈদ জাফরির কয়েকটা উর্দু সংলাপ বলার কায়েদাকে একটু ঘুরিয়ে বলার প্রস্তাব দেন সত্যজিৎ রায়কে, যেটা সত্যজিৎ রায় খোলা মনে গ্রহণ করেছিলে, কারণ সত্যজিৎ রায় জানতেন যে সাঈদ জাফরি উর্দু ভাষায় তাঁর চেয়ে অনেক বেশি পারদর্শী।
তিনি খুব লাজুক প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন
শুটিংয়ের দিনগুলো ছাড়া সত্যজিৎ রায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করতেন ও মধ্যাহ্নভোজের জন্য এক ঘণ্টা বিশ্রাম করতেন। যেহেতু শুটিংয়ের সময় অন্য সদস্যদের খুব পরিশ্রম হত তাই দুপুরে বেশ ভারী খাওয়াদাওয়া হত। খাবারে ভাত ও রুটি দুটোই থাকত, থাকত দু'রকম তরকারি যার মধ্যে একটি আমিষ, আর সঙ্গে স্যালাড ও শেষ পাতে মিষ্টি। এছাড়া চা ও কফি তো থাকতই। সত্যজিৎ রায় বাড়ি থেকে বেশ ভারী প্রাতঃরাশ করে সেটে আসতেন বলে শুটিংয়ে শুধু স্যান্ডউইচ, মিষ্টি, চা ও সিগারেট খেতেন। আমি লক্ষ্য করেছিলাম তিনি কখনও ফল খেতেন না। তিনি ফল একদম পছন্দ করতেন না। তিনি মদ্যপানও করতেন না।
সত্যজিৎ রায় সেটের একদিকে বসে ছেলে ও স্ত্রীর সঙ্গে খাওয়ার খেতেন। বাইরে শুটিং করতে যাওয়ার সময় স্ত্রী ও ছেলে সন্দীপ যেতেন তাঁর সঙ্গে। সন্দীপ তাঁর বাবার সহকারী পরিচালক ছিলেন। উনি পরিবারকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে কাজ করতেই দেখতেন বেশি।
একটু দুষ্টুমি করে অভিনেতারা ও শুটিং সেটে অন্যারা তাঁকে ভালোবেসেই 'ভগবান' বলে ডাকতেন কারণ তিনি ছিলেন 'সিনেমার ভগবান'। যদিও ওঁর সামনে কেউ তাঁকে এই নাম ডাকতে সাহস পেতেন না, তবে এমন ভাবে নিজেদের মধ্যে নামটা নিয়ে আলোচনা করতেন যাতে ওঁর কানে যায়। ওঁর আরেক সহকারী তাঁকে নাম দিয়েছিলেন 'লম্বু'। সত্যজিৎ রায় নিশ্চিত ভাবে এ সব বিষয়ে অবগত ছিলেন কিন্তু কখনও বুঝতে দেননি যে তিনি এই সব বিষয় কিছু জানেন।
শুটিংয়ের সময় তিনি শুটিংয়ের কাজ না এগিয়ে কখনও বেরিয়ে যেতেন না। বরং, তিনি পরের দিনের কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখতেন। পরের দিনের যেই দৃশ্যটি শুট করা হবে সেই পরিকল্পনা করা বা সংলাপ লেখা অথবা যে সব গানের সুর উনি আগেই দিয়েছেন সেই গানগুলোর কথা লেখা –এই সব কাজগুলো সারতেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে সত্যজিৎ রায় বেশ অস্বস্তি বোধ করতেন। সত্যজিৎ রায় নিজের গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন থাকা সত্ত্বেও, তিনি খুব লাজুক প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। ওঁর সম্বন্ধে একটা কথা প্রচলিত ছিল, "সত্যজিৎকে কষ্ট দিতে হলে তাকে পার্টিতে নিয়ে যেতে হবে।"রায়ের ছবির শেষে কখনও কোনও পার্টি হত না।
সৌজন্যে: মেল টুডে