কলকাতার অফিস পাড়া ডালহৌসির নাম হওয়া উচিৎ স্কটিশ পাড়া

ইংরেজ আমলে বাড়িগুলোর অধিকাংশই ছিল ম্যানেজিং এজেন্সিগুলোর অফিস

 |  3-minute read |   27-03-2018
  • Total Shares

কলকাতা শহরে বিশেষ কিছু পাড়া বিশেষ কিছু শ্রেণীর বা পেশার মানুষের বাসস্থান হিসেবে বিখ্যাত, সেটা আমরা জানি। যেমন ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়া বা শাঁখারীপাড়া। কিন্তু সেই হিসেবে, কলকাতার অফিস পাড়া, অর্থাৎ ডালহাউসির নাম হওয়া উচিত স্কটিশ পাড়া। কেন? বাড়িরগুলোর নামই ভেবে দেখুন। Finlay Muir, Shaw Wallace, Balmer Lawrie, McLleod, Turner Morrison, Mackinnon Mackenzie, সবই তো স্কটিশ নাম। আজ সেই সমস্ত কোম্পানিগুলো ভারতীয়দের হাতে রয়েছে। কিন্তু একসময়, ডালহাউসিতে রাজত্ব চলত স্কটল্যান্ডের।

আমরা ব্রিটিশ রাজ বলতে ইংরেজ, অর্থাৎ ইংল্যান্ডের বাসিন্দাদের কথা ভাবলেও ব্যবসার বিষয়ে কিন্তু স্কটল্যান্ড বরাবরই এগিয়ে। এবং এর শুরু ১৭০৬-এ, যখন Act of Union-এর ফলে, ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ড মিলে তৈরি হল গ্রেট ব্রিটেন। দুই দেশের মধ্যে, স্বাভাবিক ভাবেই, এর পর আর কোনও আমদানি অথবা রপ্তানি শুল্ক রইল না। তার ফলে, ইংল্যান্ডের উপনিবেশেষগুলোতে, বিশেষ করে আমেরিকায় রমরমিয়ে চলতে শুরু করল স্কটল্যান্ডের ব্যবসা। তারপর এল Scottish Enlightenment, যার ফলে ব্যাপক হারে শিক্ষা এবং সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হল। ১৭৬০ থেকে ১৮৪০-এর মধ্যে এল শিল্প বিপ্লব যাতে উন্নতি সব থেকে বেশি হয় স্কটল্যান্ডের। নিজেদের কারখানার জন্যে কাঁচামাল আর তৈরি জিনিসের জন্য বাজার খুঁজতে স্কটরা পাড়ি দিতে শুরু করলেন ভারতে। কলকাতায় তখন প্রধান বন্দর ডালহাউসির পাশেই। ডালহৌসি চত্বর বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠল। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এল ১৮৩০ নাগাদ, যখন ব্যবসায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একাধিকার শেষ হল।

body_032718042833.jpgডালহৌসির স্কটিশ বাড়িগুলো

body1_032718042931.jpgসেন্ট অ্যান্ড্রু'স গির্জা

এই রকম সময় কলকাতায় চালু হল এক নতুন ধরণের ব্যবসা, যার কথা হিসাবশাস্ত্রের ছাত্রছাত্রীরা পড়েছেন - ম্যানেজিং এজেন্সি। এই ম্যানেজিং এজেন্সির কাজ কী? ধরুন আপনি ইংরেজ। ভারতে কারখানা শুরু করতে চান, কিন্তু সেখানে কাউকে চেনেন না, কী করে কি করবেন, কিছুই জানেন না। ম্যানেজিং এজেন্সি আপনার ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য যা যা করতে হয়, সব করবে। অথবা ধরুন, আপনার কাছে পুঁজি আছে, কিন্তু ব্যবসায় কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ম্যানেজিং এজেন্সি আপনার জন্য অভিজ্ঞ লোক জোগাড় করে দেবে যারা আপনার ব্যবসা চালাতে পারবে। অথবা ধরুন, আপনি একটি কারখানা খুললেন, বা ব্যবসা শুরু করলেন, কিন্তু তার দৈনন্দিন কাজের সব খুচরো ঝামেলা আপনি সামলাতে চান না। আপনার হয়ে আপনার ব্যবসা ম্যানেজিং এজেন্সি চালিয়ে দেবে। এর জন্যে তারা মোটা টাকা পাবে, লেখাই বাহুল্য। এই এজেন্সিগুলোর কিছু সমস্যা ছিল, তার মধ্যে একটি হল যে, কোম্পানির লাভ হোক বা ক্ষতি, ম্যানেজিং এজেন্সি তার টাকা পাবেই। যার ফলে, এজেন্সি যে সব সময় কোম্পানির হয়েই কাজ করত তা নয়। তা ছাড়াও আইনে ফাঁকি দিয়ে অনেক কারচুপি করার সুযোগই ছিল। এমনি একটি এজেন্সির গল্প আমরা পড়ি শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড গল্পে।

চা এবং চট-- এই দুই শিল্পতেই ম্যানেজিং এজেন্সিদের সবচেয়ে বেশি দেখা যেত। ১৯৭০ সালে যখন ম্যানেজিং এজেন্সি আইন করে বন্ধ করা হয়, তখন বামার লরি প্রায় ৪০টি চা বাগানের ম্যানেজিং এজেন্ট ছিল। তা ছাড়াও ছিল বিমার দালালি, জাহাজ কোম্পানির দালালি প্রভৃতি। আজকের ডালহৌসিতে যে বিশাল বিশাল ইংরেজ আমলের বাড়িগুলো আমরা দেখতে পাই, তার মধ্যে সিংহভাগ ছিল এই ম্যানেজিং এজেন্সিদের অফিস। তা ছাড়া ছিল ইন্সিওরেন্সের কোম্পানি, যেমন Gillander House-এর পাশেই Oriental Assurance, বা টেলিফোন ভবনের উল্টোদিকে Standard Life Assurance. তা ছাড়া ছিল দু'টি বড় জাহাজের কোম্পানি, Turner Morrison এবং Mackinnon Mackenzie । দু'টি কোম্পানির বাড়িই এখনও রয়েছে। অনেক সময়ই ব্যবসা করতে গিয়ে এমন কিছু করতে হাত যা করার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না, যেমন ধরুন Turner Morrison প্রচুর কাঠ-খড় পুড়িয়ে ডাক, অর্থাৎ mail-এর কন্ট্রাক্ট পেল, কিন্তু সরকার হুকুম করলেন, ডাকের সঙ্গে কালাপানিতে বন্দিও নিয়ে যেতে হবে। আমাদের যে সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই হয়ত গেছেন Turner Morrison-এর জাহাজে।

ডালহৌসির ইংরেজ আমলের স্থাপত্য আজ স্কটল্যান্ডের এই ইতিহাসের সাক্ষী। তার সঙ্গে রয়েছে রাইটার্সের পাশেই St Andrew's Church, যা আসলে একটি স্কটিশ গির্জা। আরও একটি স্মৃতিচিহ্ন রয়ে গেছে, ডালহৌসি থেকে দূরে, মল্লিকবাজারের কাছে। রাহমানিয়া বিরিয়ানির দোকান ছাড়িয়ে, দক্ষিণের দিকে একটু এগোলেই, বাঁ দিকে পড়ে একটি সরু গলি। সেই গলির শেষেই রয়েছে স্কটিশ গোরস্থান। বহুকাল অযত্নে পড়ে থেকে প্রায় জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। কয়েক বছর আগে স্কটল্যান্ডের সরকার এই গোরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Deepanjan Ghosh Deepanjan Ghosh @doubledolphin

Traveller. History buff. Dalrymple fan. Blogger.

Comment