লেটার-বক্স খুলতেই বেরোলো সত্যজিৎ রায়ের হাতের লেখায় চিঠি
কেন যেন খুব কাছের মনে হতো মানুষটাকে, যিনি আমাকে, আমাদের বুঝতে পারেন
- Total Shares
খুব ছোটোবেলা থেকেই সন্দেশ পত্রিকার গ্রাহক ছিলাম আমি। বাড়ির প্রায় পাশেই ছিল সন্দেশ পত্রিকার অফিস । সেখানে তখন সপরিবারে থাকতেন সন্দেশ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদিকা শ্রদ্ধেয়া নলিনী দাশ। পত্রিকার আর দুই সম্পাদক ছিলেন তখন সত্যজিৎ রায় আর লীলা মজুমদার। তাঁরা অবশ্য ও বাড়িতে বাস করতেন না। গ্রাহক হবার সুবাদেই হোক আর বাড়ির কাছে থাকার কারণেই হোক সময়ে-অসময়ে হানা দিতাম সন্দেশ পত্রিকার অফিসে, অনেক গল্প হতো নলিনীদির সঙ্গে, হাতে ধরে পত্রিকা ছাপার নানান কাজ শিখিয়েছিলেন নলিনীদি। ওই বাড়িতে বসেই দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের নিজের হাতে লেখা রচনার প্রুফ, ঘাঁটাঘাঁটি করেছি তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে। বাড়ির একটা জায়গায়ে প্রায় সাড়ে ছ’ফুট উচ্চতায় দেয়ালে একটা দাগ কাটা ছিল! কেন জিজ্ঞেস করাতে নলিনীদি হাসতে হাসতে বলেছিলেন- ওটা মাণিকের হাইট! বাড়ির ছোটদের বলা হয় ওটাকে লক্ষ্য রেখে এগোতে!
না ঐ উচ্চতার কাছাকাছি যেতে পারিনি কখনোই, তবে নানান সময়ে ও কাজে একেবারে পাশ থেকে দেখেছিলাম মানুষটিকে। সন্দেশ বাদ দিলেও, আমি যে ইস্কুলে পড়াশোনা করেছিলাম তার সঙ্গে ছিল সত্যজিৎবাবুর নিবিড় যোগাযোগ। ইস্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সময় পেলে আসতে দেখেছি তাঁকে আর কখনো কখনো নলিনীদিই পত্রিকার নানান কাজে জন্য পাঠাতেন বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই বাড়িতে। দরকারি ফাইল অথবা চিঠি নিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকেছি ওনার কাজের ঘরের সেই কেদারার পাশটিতে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছি ওনার ঘরের বই-পত্র আর পিয়ানোটা। উনি সময় নিয়ে কাজ সেরে আবার হাতে তুলে দিয়েছেন দরকারি কাগজপত্র, লেখা আঁকা আরো কতো কী! কথা বলবো কী, এমন একটা ব্যক্তিত্ব ছিল মানুষটার নিজের নামটুকু পর্যন্ত বলে আলাপ করার সাহস পাইনি কখনো!
অথচ তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিয়মিত চিঠি লিখে চলেছি ওনাকে! কতোই বা বয়স তখন- বছর বারো-তেরো হবে। আমাদের তো বড় হয়ে ওঠাই তো সত্যজিৎ রায়ের পরিমন্ডলে। ওনার সিনেমা দেখছি, সাক্ষাৎকার পড়ছি বা শুনছি, পড়ে গুলে ফেলছি গল্প আর উপন্যাস। নতুন কোনো লেখা কোথাও বেরোলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছি তার ওপর। শঙ্কু-ফেলুদা তো আছেই, পড়ে পড়ে যা তখন প্রায় মুখস্থ আর তা বাদে একটার পর একটা অন্য স্বাদের ছোটো গল্প লিখে সত্যজিৎবাবু তখন আমাদের হৃদয় লুঠ করে নিয়েছিলেন। কেন যেন খুব কাছের মনে হতো মানুষটাকে, যিনি আমাকে,আমাদের বুঝতে পারেন। ঠিক যেমনটা মনে হতো রবি ঠাকুরের লেখা পড়ে। আর তাই, রবি ঠাকুর তো আর নেই নিজের নানা কথা আর ভাবনার কথা জানিয়ে কবে থেকে যেন চিঠি লিখতে শুরু করেছিলাম ওনাকে! উত্তরের প্রত্যাশা করিনি কখনোই।
তারপর হঠাৎ একদিন এলো সেই দিনটা- বাড়িরা ডাক বাকসো খুলে দেখি আমার নাম লেখা একটা সাদা খাম। খাম খুলতে বেরোলো, আমার নামে সত্যজিৎবাবুর স্বহস্তে লেখা একটা চিঠি! তারপরেও আরো চিঠি লিখেছি ওনাকে, কার্ডও পাঠিয়েছি জন্মদিনে, দেখাও হয়েছি সামনা-সামনি, কিন্তু ‘ভক্ত’-র দুঃখ একটাই কোনোদিনও নামটা বলে আর সরাসরি আলাপ করা হয়ে ওঠেনি ওনার সঙ্গে!